জানা অজানা — নতুনপাতা
নওপাড়ার ইতিবৃত্ত
তপন কুমার বৈরাগ্য
বর্তমানে নওপাড়া গ্রামটি বগপুর পঞ্চায়েতের অধীন।
ইহা নাদনঘাট থানা ও কালনা মহকুমার অন্তর্গত।
নিকটবর্তী স্টেশন নবদ্বীপ বা সমুদ্রগড়।
নওপাড়া গ্রামটি প্রায় চারশো বছরের প্রাচীন।
বর্তমানে যে গ্রামটির নাম নওপাড়া তখন সেখানে
বাস করতেন চৌধুরী পরিবারের জমিদাররা।
এখানে তখন নয়টি পাড়া ছিলো। এই পাড়াগলো
হলো--চৌধুরীপাড়া,মুসলমানপাড়া,গড়াইপাড়া,
পূর্বদাসপাড়া যাকে বলা হতো ফতেপুর,
পশ্চিমদাসপাড়া,উগ্রক্ষত্রিয়পাড়া,পালপাড়া,
বদ্যিপাড়া ,বাগদিপাড়া।
এই গ্রামের মানসিংহ চৌধুরী প্রায় চারশো বছর আগে
নওপাড়া গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন একজন
শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।তার ভাই ছিলেন যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী।
সেই সময়ের একজন খ্যাতিমান ডাক্তার।তিনি
দরিদ্রের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
তিনি ছিলেন গরিবের ভগবান। এই গ্রামে সেন বংশের
জমিদাররাও অনেক স্মরণীয় কীর্তি রেখে গেছেন।
এই গ্রামের একজন স্মরণীয় ও বরণীয় ব্যক্তি ছিলেন
বিমলানন্দ তর্কতীর্থ মহাশয়। তিনি বাংলার রূপকার
বিধানচন্দ্র রায়ের অতি প্রিয় পাত্র ছিলেন।
তার মন্ত্রীসভায় তিনি ছিলেন সহকারী অধ্যক্ষ।
তিনি ছিলেন একজন মাটির মানুষ। এই গ্রামের
অপর একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন মনোরঞ্জন সেন।
তিনি ছিলেন একজন এম,এল,সি।এই গ্রামের জন্য
তিনি অনেক কাজ করে গেছেন।
এই গ্রামের খ্যতনামা ডাক্তার ছিলেন হরিহর সেন।
সেই সময় তার মতো স্বনামধন্য ডাক্তার এই অঞ্চলে
কেউ ছিলেন না। তিনি রোগিকে দেখেই বলে দিতে
পারতেন তার কি রোগ হয়েছে। তার সেবায়
এতদ্অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ লোকের রোগমুক্তি ঘটেছে।
এই গ্রামের সোনার ছেলে ছিলেন ডঃ মনোমোহন
দাস।ভারতের তখন প্রধান মন্ত্রী ছিলেন জওহর লাল
নেহেরু। তার মন্ত্রীসভার শিক্ষাদপ্তরের উপমন্ত্রী ছিলেন
ডঃ মনোমোহন দাস।তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনতা
সংগ্রামীও।
নওপাড়া গ্রাম যেন মহামূল্য রত্নের সমাহার। এই গ্রামের
বিমলানন্দ তর্কতীর্থ ছিলেন একজন প্রথিতযশা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ।জানা যায় ডাক্তার
বিধানচন্দ্র রায় পর্যন্ত তার কাছে চিকিৎসা করান।
অশোককুমার মুখোপাধ্যায় এই গ্রামেরই সন্তান।
তার পুত্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পঞ্চায়েত মন্ত্রী
ছিলেন মাননীয় সুব্রত মুখোপাধ্যায়।তাদের পাদস্পর্শে
এই গ্রাম ধন্য। মাননীয় অশোক কুমার মুখোপাধ্যায়
নাদনঘাট রামপুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে বেশ কিছুদিন
শিক্ষকতা করেন। এই গ্রামের আর এক কৃতি
সন্তান ছিলেন বিশ্বনাথ চৌধুরী।তিনি শিয়ালদহ কোর্টের
ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তার পুত্র পার্থপ্রতিম চোধুরী
ছিলেন খ্যাতনামা পরিচালক। পার্থ প্রতিম চৌধুরী
ঝড়ের আকাশ সিনেমারও পরিচালক ছিলেন।
এখানকার সু-সন্তান ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ হাজরা
মহাশয়।তিনি অলইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সদস্য
ছিলেন। এই গ্রামের কমলাকান্ত হাজরা মহাশয়,
যিনি বামপন্থী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে
যথাযথ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বর্তমানে এখানে একটি ডাকঘর আছে।এখানকার
বরেণ্য ব্যক্তি ধীরেন্দ্রনাথ হাজরা মহাশয়ের
চেষ্টায় এই ডাকঘর স্থাপিত হয়।
তাছাড়া তার অক্লান্ত পরিশ্রমে এই গ্রামে
বিদ্যুৎ আসার পথ সুগম হয়।এখানকার যে
কাছারী বাড়ি আছে ,আগে সেখানে
গ্রামের মানুষেরা সন্ধ্যার সময় উপস্থিত
হয়ে যে কোন বিষয় মিমাংসা করে নিতো।
এখন এই কাছারী বাড়িতে প্রতি বছর দুর্গা পূজা
হয়। বর্তমানে এই গ্রামে ছয়টি দুর্গা পূজা হয়।
গ্রামে একটি মসজিদও আছে।হিন্দু- মুসলমান
সকল সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে মিলেমিশে
বাস করে।
এখানে রাখাল রাজের মন্দির আছে।ফাল্গুনমাসে
দোলপূর্ণিমায় এখানে হরিনাম সংকীর্তন হয়।
তাছাড়া প্রতিদিন এখানে সন্ধ্যাবেলায় হরিনাম
সংকীর্তন হয়। এখানে সিদ্ধেশ্বরী মন্দির আছে।
বুদ্ধ পূর্ণিমায় সিদ্ধেশ্বরী পূজো হয় এবং মেলা বসে।
আগে এখানে সাতদিন ধরে যাত্রা উৎসব হতো।
কথিত আছে মা সিদ্ধেশ্বরী আগে সাহাজাদপুরে বিরাজমান ছিলো। এখানকার নমঃশূদ্র পরিবার এই পূজো করতো।পূজোর শেষে তারা মাকে খড়ি নদীতে
বিসর্জন দিতো ।একবার পূজায় অনাচার হয়।
মা জমিদার মানসিংহ চৌধুরীকে স্বপ্নাদেশ দেয়---
তোরা সাহাজাদপুর থেকে আমাকে নিয়ে এসে
এখানে মন্দির নির্মাণ করে পূজার ব্যবস্থা
কর। মানসিংহ মায়ের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে
পালন করেন।প্রায় চারশো বছর ধরে নওপাড়ায়
সিদ্ধেশ্বরী পূজো হয়ে আসছে।
আগে এখানে অম্বুবাচী পূজোয় খুব ধুম হতো।
এখন সেই পূজা বন্ধ হয়ে গেছে।
নওপাড়ায় ভাদ্রমাসে মনসা পূজা হয়। মা মনসার
মন্দিরও আছে। এখানে শিবের মন্দির,লোকনাথের
মন্দিরও আছে। নওপাড়ায় আগে সিদ্ধেশ্বরী লাইব্রেরী
ছিলো।১৯৯০ সাল পর্যন্ত যার অস্তিত্ব ছিলো। এখানে
একটি সৌখিন নাট্যদলও ছিলো।
এখানে নট সম্রাট স্বপন কুমারের নামে যাত্রা মঞ্চ আছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের
প্রচেষ্টায় এই মঞ্চ স্থাপিত হয়। এখানে প্রতিবছর
সাত- আট দিন ধরে যাত্রা উৎসব ও সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।এই উপলক্ষে এখানে
বিরাট মেলাও বসে।
এখানকার পল্লীশ্রী ক্লাব সব ধরণের কাজে
অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া এখানে আছে
আদি মিলন সংঘ,রাখাল রাজ সংঘ।
এখানে আছে একটি উচ্চ বিদ্যালয়।১৯৬৭ সালে
ইহা প্রতিষ্ঠিত হয়।আছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়,
একটি শিশুশিক্ষা কেন্দ্র,চারটি অঙ্গনারী কেন্দ্র।
আছে একটি আনন্দমার্গ বিদ্যালয় ।আছে একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র।
এখানে আছে একটি বিরাট সজল ধারা প্রকল্প
এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলে জল সরবরাহ করা।
এটি উদ্ভোধন করেন প্রয়াত মন্ত্রী মাননীয় সুব্রত
মুখোপাধ্যায় মহাশয়। গ্রামে আগের চেয়ে যাতায়াতের
সুযোগ সুবিধা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। নওপাড়া থেকে
১৯৯২ সালে প্রথম সাহিত্য পত্রিকা সহযোদ্ধা প্রকাশিত
হয়।সম্পাদনা করেন মানস হাজরা মহাশয়।
পত্রিকাটি প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলেছিল।
নওপাড়ায় প্রতি বছর কলকাতার সব বিখ্যাত
দলের যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হতো। এই গ্রামে
মহানায়ক তপন কুমার, নট সম্রাট স্বপন কুমার,
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতা শান্তিগোপাল,
জ্যোৎস্না দত্তের মত অভিনেত্রী অভিনেতারা অভিনয়
করে গেছেন।
Comments :0