Jadavpur University

তোলাবাজির অভিযোগও উঠছে হস্টেলের ‘মাথাদের’ বিরুদ্ধে

রাজ্য কলকাতা

 যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে প্রথম বর্ষের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় শুক্রবার গ্রেপ্তার হওয়া তিন ছাত্রকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ হেপাজতে রাখার নির্দেশ দিল আলিপুর আদালত। ধৃতদের মধ্যে দুই ছাত্র প্রাক্তনী ও একজন বর্তমান ছাত্র। নোটিস দিয়ে যাদবপুর থানায় শুক্রবার দুপুরে ডেকে এনে দীর্ঘ জেরার পর শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয় তাদের। যাদবপুরকাণ্ডে ধৃতের সংখ্যা হলো ১২।
শনিবার আলিপুর আদালতে ধৃতদের পেশ করা হলে সরকারি আইনজীবী অভিযুক্তদের জামিনের আবেদনের বিরোধিতা করে বলেন, ‘এরা প্রত্যেকে সফল অপরাধী, কিন্তু ব্যর্থ অভিনেতা। প্রথম থেকেই এরা তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করতে এক একজন এক একরকম কথা বলছে। কোনও ভাবেই যেন অভিযোগ প্রমাণ করা না যায় সেজন্য এই কৌশল নিয়েছে তারা।’
তবে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। থানার এত কাছে ওই হস্টেল। তৃণমূলের কথায় ওঠাবসা করা পুলিশ কী করছিল এতদিন? যে পুলিশ জলপাইগুড়িতে সিপিআই(এম) পার্টি অফিসে ঢুকে গ্রেপ্তার করে পার্টিনেতাদের, আনিস খানের বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল গভীর রাতে, সেই পুলিশ যাদবপুরের মেইন হস্টেলের দরজা থেকে ঘটনার দিন রাতে কোনও প্রভাবশালীর কথায় ফিরে গিয়েছিল?
জানা গেছে, শুক্রবার হাজিরা দেওয়ার পর তাদের ঘটনার পুনর্নির্মাণের জন্য ঘটনাস্থলে নিয়ে গেলে অভিযুক্তরা তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু সন্ধ্যায় পুলিশের হাতে ধৃতদের সামনে বসিয়ে জেরা করতেই ধরা পড়ে গেছে তাদের অভিনয়। এরপরেই শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয় তিন জনকে। ধৃতদের মধ্যে রয়েছে রসায়ন বিভাগের প্রাক্তনী শেখ নাসিম আখতার, গণিত বিভাগের প্রাক্তনী হিমাংশু কর্মকার এবং সত্যব্রত রায় নামে কম্পিউটার সায়েন্সের চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্র।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ধৃত তিনজনই ঘটনার দিন মেইন হস্টেলের এ-টু ব্লকের ১০৪ নম্বর ঘরে ছিলেন। বর্তমান ছাত্র সত্যব্রত রায় ৯ তারিখ ঘটনার দিন রাতে ডিন অব স্টুডেন্টস রজত রায়কে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে হস্টেলে ‘পলিটিসাইজড’ হচ্ছে। বিষয়টি কী তা জানতে চাওয়া হলে অভিযুক্ত জানিয়েছে, হস্টেল থেকে এক ছাত্রকে নাকি ঝাঁপ দিতে বলা হয়েছে।
তদন্তকারীরা যাদবপুরের ধৃত ছাত্রদের লাগাতার জেরা করার পাশাপাশি এখনও থেকে যাওয়া বিভিন্ন পড়ুয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাতে প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে। শনিবার ফের হস্টেলের সিনিয়র আবাসিকদের বিরুদ্ধে উঠল তোলাবাজির অভিযোগ। হস্টেলে নবাগত ছাত্রদের কাছ থেকে ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে টাকা নিতে চলতো তোলাবাজি। সেই টাকায় নাকি প্রাক্তনীরা মদ ও অন্যান্য খাবার খেতো।
অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে হস্টেলে খাবার আনিয়ে তা পেমেন্ট করতে বলা হতো প্রথম বর্ষের নবাগতদের। যত জিজ্ঞাসাবাদ চলছে ততই প্রাক্তনীদের অত্যাচারের কথা সামনে আসছে। গোয়েন্দাদের দাবি হস্টেলে সৌরভ চৌধুরির নেতৃত্বে নাকি চলত ওই তোলাবাজি চক্র। এই সৌরভ চৌধুরি তৃণমূলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। 
হস্টেলে আগত নতুন ছাত্রদের কার কেমন আর্থিক সামর্থ্য তা আগে থেকে বুঝে নেওয়া হতো। তারপর বিভিন্ন সময় অনলাইনে অর্ডার করা খাবার বা মদের দাম মেটাতে বাধ্য করা হত তাদের। এভাবেই প্রথম বর্ষের ছাত্রদের টাকায় মোচ্ছব করতেন সিনিয়ররা। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, কোন কোন ছাত্রের থেকে মোটা টাকা আদায় করা যাবে তা আগে থেকে তালিকা নাকি রাখতেন সৌরভ চৌধুরিরা। দরকার হলেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মতো ব্যবহার করা হত সেই সব ছাত্রকে।
এই সূত্রেই নাকি এক টাকা উপার্জন না করে তোলাবাজির টাকা অনেক প্রাক্তনী বাড়িতে পাঠাতো। হস্টেলকে রীতিমতো টাকা রোজগারের পথ বানিয়ে ফেলেছিলেন প্রাক্তনী কিছু ছাত্র। একদিকে হস্টেলে থাকতে না পেরে যখন যাদবপুরে পড়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয় অনেক মেধাবী ছাত্রকে, তখন প্রাক্তনীদের হস্টেলের ঘর বছরের পর বছর দখল করে রেখেছে প্রাক্তনীরা। সব কিছুই জেনেই চুপ করে ছিল কর্তৃপক্ষ। কীসের ভয়ে তাঁরা এতদিন চুপ করে ছিলেন, সেটাই এখন প্রশ্নের মুখে। তবেই এই সবের মধ্যেই যাদবপুরকাণ্ডে তদন্তকারীদের অতিসক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু হলো। ‘মোটিভ’ না পেয়ে যেভাবে গোয়েন্দারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর পাঁচটা পড়ুয়ার ওপর চাপ তৈরি করছেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
এদিকে, যাদবপুরে পড়ুয়ার মৃত্যুর পর র্যা গিংয়ের অভিযোগ ওঠায় ইউজিসি’র তলব করা প্রাথমিক রিপোর্ট শুক্রবার পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেই রিপোর্টে সন্তুষ্ট নয় ইউজিসি। ফের রিপোর্ট পাঠাতে বলে ছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে। সংস্থার নির্ধারিত সময় মধ্যে ‘প্রথম রিপোর্ট’ পাঠালেও সেখানে প্রকৃত ঘটনা ও তার পরিপ্রেক্ষিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কী ব্যবস্থা নিয়েছে তার কোন উল্লেখ নেই বলে ফের রিপোর্ট তলব। 
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক স্নেহমঞ্জু বসু জানিয়েছেন, ইউজিসি’র পাঠানো ১২টি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর ও ৩১টি ফাইল পাঠানো হয়েছে ইউজিসি’তে। ঘটনার পর থেকেই গোটা বিষয়টি নিয়ে যাদবপুর থানার পাশাপাশি কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশ যেভাবে তদন্ত শুরু করে ধরপাকড় শুরু করেছে, তাতে ইউজিসি’র তরফেও বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তাহলে এমন পরিমণ্ডল কতদিন ধরে চলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে !
বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অবশ্য শনিবার দাবি করা হয়েছে, রিপোর্ট পেয়ে সন্তুষ্ট ইউজিসি। ইউজিসি-র  যে প্রতিনিধিদল আসার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সেই সফর বাতিল করেছে। নিবন্ধকের দাবি করেন, যেহেতু তাঁরা রির্পোটে সন্তুষ্ট তাই ইউজিসি’র প্রতিনিধি দল আসবে না। কিন্তু গত সোমবারে পাঠানোর কথা রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ফের বৃহস্পতিবার  যাদবপুর কর্তৃপক্ষের ১২টি প্রশ্নের জবাব চায় ইউজিসি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত তথ্য পাঠাতে না পারলে কড়া ব্যবস্থার কথা বলতেই শুক্রবার সকালে পাঠানো হয় ওই প্রশ্নের উত্তর সম্বলিত রিপোর্ট।

Comments :0

Login to leave a comment