মুক্তধারা
অন্যকথা
টিনের তলোয়ারের ধার
কৃশানু ভট্টাচার্য
আপস করে বাঁচতে বাঁচতে শেষ মুহূর্তে মরালিটিকে ভুলতে পারেননি বেণীমাধব চ্যাটুজ্যে ওরফে কাঁপ্তেন বাবু। বিধবার হবিষ্যি কিংবা সধবার একাদশীর সংলাপ বলতে বলতে হঠাৎ করে তার গলায় শোনা গিয়েছিল প্রিয়নাথের লেখা তিতুমীরের সংলাপ। শোনা গিয়েছিল ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। আর তার সেই বদল সঞ্চারিত করেছিল এক অনুপম উত্তেজনা তার সহযোগীদের মধ্যে। সংস্কৃতি যখন দলবদ্ধ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে মানুষের সামনে উপস্থাপিত হয় তখন সেখানে একজন দলনেতা থাকেন। দলের মানুষ সেই নেতাকে সামনে রেখেই এগিয়ে যায়। আর সেই নেতার পদস্খলন কিংবা মানবিক উন্নতির উপর নির্ভর করে দলের অন্য সদস্যদের এগিয়ে যাওয়া কিংবা পিছিয়ে পড়া। এটা যেমন থিয়েটারের ক্ষেত্র সত্য, এটা সত্য যে কোন সঙ্ঘবদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে। কারণ সংস্কৃতি তো শুধুমাত্র বিনোদন নয় - আমোদ প্রমোদ, হাসি কান্নার পাঁচমেশালী অনুকরণ! সংস্কৃতি আনন্দ দিতে দিতে মানুষকে শেখায় কিভাবে চলতে হয়, কি কথা ভাবতে হয়, কি কাজ করতে হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছিলেন থিয়েটারে লোকশিক্ষা হয়। একথা থিয়েটারের ক্ষেত্র যেমন সত্য, তেমনই সত্য চলচ্চিত্র কিংবা বিভিন্ন ধরনের মাধ্যমে থিয়েটার ধর্মী পরিবেশনায়। আর তাই যখন টেলিভিশনের পর্দায় এক স্বামী তিন বউ, কুচুটে ননদ, যাদুকর নায়ক কিংবা জাদুকরী নায়িকা বিপুল দর্পে পদচারনা করেন তখন রাতের অন্ধকারে কেউ কেউ পিঠে বানানোর জন্য ওই ধারাবাহিকের দর্শকদের ডেকে নিয়ে যায়। তবুও প্রতিবাদ হয় , কারণ সংস্কৃতি প্রতিবাদ করতেও শেখায়।
আর সে কারণেই যারা সংস্কৃতির পরিচালক হন নির্দেশক কিংবা নিয়ন্ত্রক তাদের নীতিবোধটা খুব শক্তিশালী হতে হয়। কারণ তাকে একদিকে তার দলের সকলের অস্তিত্ব সেটি অর্থনৈতিক এবং জাগতিক এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে শিল্পসৃষ্টির দায়বদ্ধতার প্রতি সচেতন থাকতে হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে সেই অস্তিত্বের লড়াইয়ের দোহাই দিয়ে কোনরকম অনৈতিক আপোষ সংস্কৃতি দাবি করে না। টিনের তলোয়ারের কাপ্তেনবাবু শেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যেন ফুটবল খেলার এক্সট্রা টাইমের শেষ মিনিটে গোল শোধ করে ম্যাচটি গোল শূন্য রাখছেন।
আমাদের চারপাশে এমন অনেক স্রষ্টা রয়েছেন যারা কেবলমাত্র প্রথম দায়বদ্ধতা তার কথা মাথায় রেখেই দ্বিতীয় দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করেন। শাসকের রক্তচক্ষু কিংবা সংস্কৃতি বিক্রি করে পেট চালানোর দায়বদ্ধ তাকেই তারা বেশি প্রাধান্য দেন। আর সেই কারণেই তাদের টিনের তলোয়ার টিনেরই থেকে যায়। সে তরবারিতে কোন ধার থাকেনা থাকে না কোন সংগ্রাম করবার মতো তেজ। হাসতে হাসতে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রুপের কষাঘাতে যে সংস্কৃতি ঝলসে উঠতে পারে এ বাংলায় তার নজির কম নেই। জরুরি অবস্থার সময় দাঁড়িয়ে সরকারের শাসন কে প্রকাশ্যে না প্রত্যক্ষভাবে প্রতিরোধ করবার সাহস দেখিয়েছিলেন এই বাংলার নাট্যকার। তারও আগে ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে গান কবিতা নাটকে ব্যবহার করে বিনয় রায় ,সলিল চৌধুরী , হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাসের গণনাট্য আন্দোলন এই বাংলার ইতিহাস। আর সেই ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার আমরা বহন করে চলেছি।
তাই দেখতে টিনের হলেও আমাদের হাতের তরবারি যেন ইস্পাতের থেকেও শক্তিশালী হয়, কলম যেন ধারালো হয় বল্লমির চেয়েও।
Comments :0