MUKTADHARA GOLPO 12 JUNE

মুক্তধারা / গল্প / দেহ স্বত্ব

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA  NEW GOLPO 12 JUNE
গল্প
দেহ স্বত্ব
সেঁজুতি চক্রবর্তী
 
 
‘অ‌ বউ কালকেও খেয়েছিস?’
অপ্রস্তুত হয় রুমি, অবচেতনেই ডান কপাল ঢেকে দেয় খোলা চুলে। 
‘এমনি এমনি কি খোলা চুলে তুই রান্না করিস? আর কত ঢাকবি বউ?’ 
প্রায় চিৎকার করে ওঠে অন্নদা। বড় মায়া পরে গেছে  এই অভাগী মেয়েটা উপর। বড়লোক বাড়ির সবেধন নীলমণি ছেলের বউ। কত আদরে, কত আদিখ্যেতায় থাকার কথা ছিল! অন্নদা তো শুধু রান্না করে, মাস গেলে মাইনে পায়। এ মেয়ে সারাদিন খেটে মরে, রাতে কালশিটে পায়। 
‘তুমি তাড়াতাড়ি করো দিদি। দেরি হলে গাল শুনবে।’ 
‘হ! আমারে গাল দেবে! অমন মুখে নুড়ো জ্বালি! তুই নিজের কথা ভাব। আর কতদিন সইবি বউ? তোকে দেখে আমি তো আর সইতে পারি না।’   
‘কি করব দিদি? বিয়ের সময় বিধবা মা বলে দিয়েছিল ও সংসারে আমার আর ঠাঁই হবে না। ভালো হোক, মন্দ হোক আমাকেই মানিয়ে নিতে হবে।‘ 
অন্নদা আর একবার ভালো করে নিরীক্ষণ করে রুমিকে। মাত্র চারমাস আগে কত ধুমধাম করে লক্ষী প্রিতিমা বউ আনলে বড় লোকের ব্যাটা, আর আজ তার ছিড়ি দেখো! কপালে ঢিবি, ঠোঁট কাটা। ধবধবে অঙ্গে কত কালশিটে! মা গো মা! ঘেন্না ধরে এদের বৈভবে! 
 
‘কেন মারে রে তোকে? স্বামীকে সুখ দিতে পারিস নে বুঝি?’ সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে।
মুখ নিচু করে মেঝে জরিপ করে রুমি। দোষটা নিশ্চিত তারই। প্রথম একমাস তো দিব্যি ভালোবেসেছিল বর। তারপর বিরক্তি, ক্রমে অত্যাচার। রুমির রূপই আছে, কাম নেই। বিছানায়পরে থাকে যেন মরা ইলিশ। তাই চকচকে ফর্সা ত্বকে গাঢ় নীল কালশিটে ফেলতে ভালোই লাগে স্বামীর। তবু যদি একটু শীৎকার বের হয় বোবামুখ দিয়ে! বোকা মেয়েটা কাঁদেও না। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টাও করে না। আরও রাগ হয় স্বামীর। কামড়ে যোনি ছিঁড়ে নিতে চায়। আঁচড়ে সুকুমার স্তনবৃন্ত উপড়ে ফেলতে চায়। রুমি জেনে গেছে রক্তের নোনা স্বাদ মুখে লাগলে খান্ত দেবে স্বামী। রোজকার রক্তক্ষরণে স্বস্তি পায় রুমি। সম্ভোগের থেকেও বেশি সুখ যে অত্যাচারে আবিষ্কার করে ফেলেছে তার স্বামী।
‘তুই তাহলে ছেড়ে যাবি না পোড়ার মুখো কে?’ কঠোর প্রশ্ন অন্নদার। আজ একটা হেস্তনেস্ত সে করেই ছাড়বে। গরিব যদি গরিব রে না দেখে ভগবান কারে দেখবে?
‘বেশ! ছেড়ে যাবি না যখন চেপে ধর। এমন করে ধর যেন কালনাগিনী প্যাঁচ।’ ক্রুর স্বরে অন্নদা যেন হিস্ হিস্ করে ওঠে। 
অভিভূত হয়ে যায় রুমি। অন্নদা তাকে কাছে টেনে এনে বসায়। রুমি যেন ছোটবেলার রূপকথা শুনছে এমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে মধ্যবয়সি নগন্য এক রাঁধুনির দিকে। 
‘শোন বউ, আমার দিদিমা ছিল নামজাদা বেশ্যা। আজকাল তো কোনও কিছুরই দাম নেই, কদর নেই। কিন্তু সে যুগে গুণী মানুষের কদর ছিল। সাহেবরা নাকি তাকে বলত শিল্পী। ওই আর্টিস্ট না কি বলে না রে! কলেজ স্ট্রিটে ইয়া বড় কুঠি ছিল। অনেক টাকা, হীরে জহরত। কিন্তু অমন যে মায়াবিনী সেও একদিন ভালোবেসে ফেলল আমার দাদুর মতন হাড় হাভাতে মানুষ কে। বিয়ে করলে। ব্যাস সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এলে এই বাঘাযতীন এর রিফিউজি ক্যাম্পে। কিন্তু বিদ্যা কি আর ছেড়ে যায় মানুষ রে? সে বিদ্যার আজও মার নেই বউ। তোরে আমি শেখাব, যেমন আমার মা আমারে শিখিয়ে ছিল। আমার তো দুটা পোলা। এমনিতেই ভেড়া। বউ দুটার হাতে আর অস্তর নাই বা তুলে দিলাম।
এ বিদ্যা যদি তুই আয়ত্ত করতে পারিস বউ তবে পৃথিবীর এমন কোন মিনসে নাই যে তোর পায়ে গড়াগড়ি দিবে না। নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে পারবি বড় বড় বাঘের ব্যাটাদের। বুঝলি বউ?’ 
ঘাড় হেলায় রুমি। কত কিছুই তো করেছে সে এই ক’মাসে। কবিরেজি, আয়ুর্বেদিক, জরিবুটি, ঘরোয়া টোটকা, মমতাময়ী এই মানুষটার কথাও না হয় শুনল একবার।
‘রোজ দুপুরে কাজ মিটলে, ঘরে তো তেমন কেউ থাকে না। আমারে ডাকবি। আমি তোর শরীরটারে গড়ে দেব। আর মনে রাখিস বউ এই বিদ্যার কথা কোনও পুরুষকে ঘুণাক্ষরেও বলিস না। শুধু মরার আগে কোনও মেয়েরেই দিয়ে যাস। আমাদেরতো শরীর ছাড়া আর কিছু নেই বউ!’
 
অন্নদা কি করলেন, কি বললেন, কোন মন্তর ফুঁকলেন, তা কেউ টের পেল না। কিন্তু সাত দিনের মাথায় রুমির নবজন্ম হলো। ঈশ্বর তাকে সুন্দরী করেছিলেন, কিন্তু সে রূপে লাস্যে এর ছোঁয়া আনলেন অন্নদা। দ্বিধাহীন স্বনির্ভরতায় রুমি নিজের শরীরের স্বত্ব নিল। প্রাণে যেন তার প্রথম বর্ষার ছাঁট এসে লাগল। বুনো বিচুটির মতন ঝোপে ঝাড়ে ঝাকরা ফুলে ভরে উঠল শরীর। 
অন্নদা ও অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন স্বামী দেবতা একমাসের মধ্যেই কেমন মেনি বিড়ালের মতন পায়ে পায়েঘুরতে শুরু করেছেন। যাক, বউটা তাহলে সুখের মুখ দেখল। 
সীমিত জ্ঞান বুদ্ধিতেও রুমি অচিরাৎ বুঝতে পারল, দেওয়াল জুড়ে যে লেখা আছে, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ তাতে কিঞ্চিৎ ই-কার এর গোলযোগ আছে। কথাটা হওয়া উচিত ছিল রমনের গুণে। রুমি এও বুঝতে পারল যে সে দুর্বলের মান খুঁইয়েছে। যা মেনে নেওয়া যায় না তা মেনে নিতে সে আর রাজি নয়। 
‘দিদি!’ হঠাৎ একদিন রুমি প্রণাম করল অন্নদাকে। ভীষণ চমকে লাফ মেরে উঠল অন্নদা। 
‘করিস কি বউ?’ 
 
‘তুমি যে আমার কোন জন্মের পুণ্য জানি না দিদি। তোমার ঋণ কোনোকালে শোধ করতে পারব না। আজ যাওয়ার বেলায় তাই এই শ্রদ্ধাটুকু নাও।’ হাসি মুখে বলে রুমি।
‘কোথাও ঘুরতে যাচ্ছিস বুঝি? তা যা বউ ঘুরে আয়।’ 
অন্নদা প্রসন্ন মনে আশীর্বাদ করেন।
‘না দিদি। ঘুরে আর আসব না। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কি শরীরের জোড়াতালিতে চলে দিদি? তুমি ছাড়া এ কথা আর কে বুঝবে বলো? শরীর ভাঙিয়েই যদি সুখ পেতে হয় তাহলে তার এত বাঁধন মানব কেন? ও সুখ আমি এমনি পাব। চলি দিদি। এখন মা’র ঘরেই যাব। তারপর যা হোক কিছু কাজ কর্ম। তেমন হলে তুমিই না হয় দুটো রান্নার কাজ দেখে দিও।’ 
‘শান্তি পা মা!’ জড়িয়ে ধরেন অন্নদা। 
প্রায় দু’দশক পর, এক প্রৌঢ়ার বলিরেখা মণ্ডিত সুন্দর মুখখানি দু’হাতের মধ্যে নিয়ে এক প্রৌঢ় আরও একবার নিরুত্তর থেকে যাওয়া সেই প্রথম প্রশ্নটা করলেন, 
‘আজও বললে না প্রিয়া, কে তোমাকে শেখালো এত সুন্দর করে আদর করতে!’
‘যাহ, এ কি কেউ কারোকে শেখায়? ভালোবাসলে এমনি আসে গো। তবে ক’জন পুরুষ আর ভালোবাসতে পারে?’ মুচকি হেসে প্রৌঢ়া জবাব দেন। আড়চোখে একবার দেখে নেন দেওয়ালে টাঙানো তাদের নব যৌবনা কন্যাটির ছবি। 
 
 
 
 
 
 

 

Comments :0

Login to leave a comment