রক্ষাকবচের নামে রাজ্যের মানুষকে নয়, তৃণমূলকে বিপদ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন মুখ্যমন্ত্রী। রবিবার শিলিগুড়িতে সাংবাদিকদের একথা বলেছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেছেন, রাজ্যের মানুষের অধিকার লুট হয়েছে তৃণমূলের হাতে, চাকরি থেকে গৃহনির্মাণের টাকা সব লুট হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মানুষের সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা করেননি। এখন রাজ্যের মানুষ জেগে উঠে প্রতিবাদ করছেন দেখে তৃণমূলের বিপদ কাটানোর জন্য রক্ষাকবচ খুঁজছেন, দিদির রক্ষাকবচের কথা বলছেন।
মানুষের প্রতিবাদের মুখে এসব করে তৃণমূল রেহাই পাবে না বলে জানিয়েছেন সেলিম। তিনি বলেছেন, আসলে তৃণমূল মনে করেছিল, নাগপুর থেকে আরএসএস’র রক্ষাকবচে ওরা রক্ষা পাবে। কিন্তু এখন রাজ্যের মানুষের যা মেজাজ, তাতে দিল্লি, কালীঘাট, নাগপুর কেউ বাঁচাতে পারবে না দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল নেতাদের। এখন মানুষ পঞ্চায়েতের প্রধান-উপপ্রধানদের ধাওয়া করছেন, বিডিও অফিসে গিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। এরপর রাজ্যের মন্ত্রীদের ঘুম কেড়ে নেবেন।
রবিবার বিকেলে শিলিগুড়িতে সিপিআই(এম) দার্জিলিঙ জেলা কমিটির দপ্তর অনিল বিশ্বাস ভবনে এই সাংবাদিক বৈঠকে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের দুর্নীতি ও জনস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। রোজগারহীন মানুষ অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। এখন গোটা রাজ্য জুড়েই লাল ঝান্ডার নেতৃত্বে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় লড়াই শুরু হয়েছে। মানুষ হিসাব বুঝে নিতে চাইছেন। দোতলা-তিনতলা বাড়ির মালিকের নাম আবাস যোজনায়, আর গৃহহীন গরিবের নাম নেই। তৃণমূলী প্রধান-উপপ্রধান, তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি, ব্লক সভাপতিরা টাকা নিয়ে নাম ঢুকিয়েছেন তালিকায়। আর প্রবল শীতে গরিব মানুষ গাছের তলায় দিন কাটাচ্ছেন। বিডিও’র কাছে গিয়ে ঘরের দাবি জানালে উলটে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। নন্দকুমারে পুলিশকে দিয়ে মারধর করানো হয়েছে।
গত অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকে সিপিআই(এম)’র ডাকে শুরু গ্রাম জাগাও, চোর তাড়াও অভিযান কর্মসূচি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সেলিম এই প্রসঙ্গে বলেছেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির জমি লুট করে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি হয়েছে। খুন, ধর্ষণ, চুরি, দুর্নীতি মুখ্যমন্ত্রী সব কিছুকেই ছোট ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চাইলেও মানুষ এগুলিকে এখন বড় করেই দেখতে পাচ্ছেন। শূন্য পদে যোগ্য প্রার্থীদের মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্তরা কখনই সুষ্ঠু নিয়োগ করতে পারে না। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজ সার্ভিস কমিশন তৈরি করা হয়েছিল। তৃণমূল সরকারের আমলে সবগুলিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা হয়েছে, বাদ যায়নি পাবলিক সার্ভিস কমিশনও।
সেলিম বলেন, রাজ্য সরকাার দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকেই তছনছ করে দিচ্ছে, সাধারণ মানুষকে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকার রেশনের অধিকার সঙ্কুচিত করছে। খাদ্যের অধিকার আইনকে ঘনঘন বদলাচ্ছে। একইভাবে বামপন্থীদের দাবিতে ১০০ দিনের কাজের অধিকার প্রথম ইউপিএ সরকার চালু করেছিল, সেটিকেও বাড়ানোর পরিবর্তে সঙ্কুচিত করেছে। সরকারের বরাদ্দ কমাচ্ছে। এরাজ্যের সরকার মানুষকে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ৩০ দিনের বেশি কাজ দিতে পারছে না। সেখানেও দুর্নীতি হচ্ছে। যাঁদের কার্ড আছে তাঁদের কাজ নেই। যাঁদের কাজ আছে, তাঁদের মজুরি নেই। আর কেন্দ্রীয় সরকার দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে লড়াই না করে রাজ্যের মানুষকে শাস্তি দিচ্ছে। আবাস যোজনায় দুর্নীতিগ্রস্ত ও মজুরির টাকা নয়ছয়কারীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং যারা দুর্নীতি করছে, তাদেরই অনেকে পতাকা পালটে বিজেপি হয়ে যাচ্ছে এবং রক্ষাকবচ পেয়ে যাচ্ছে। আবার বিজেপি থেকে পতাকা পালটে তৃণমূলে এসে দিদির রক্ষাকবচ পেয়ে যাচ্ছে। মোদী, অমিত শাহের সঙ্গে সলা করে ভাইপো, ভাইপোর স্ত্রী, শ্যালিকা এবং দলের বড় বড় নেতাদের রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত মুখ্যমন্ত্রীর রাজ্যবাসীর রক্ষাকবচ নিয়ে ভাবার সময় কোথায়!
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সেলিম বলেছেন, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে কোনও প্রকৃত বিরোধী দল নয়, এরা আসলে ‘ফেক অপোজিশন’। তৃণমূলের চুরির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওদের বিন্দুমাত্র বিশ্বাসযোগ্যতা নেই বলে এখন প্রতিদিন বামপন্থীদের নাম করছে। মানুষকে ধোঁকা দিতে ল্যাম্পপোস্ট থেকে লাল ঝান্ডা খুলে এনে নিজেদের মিছিলে ব্যবহার করতে হচ্ছে বিজেপি-কে।
তৃণমূলের পাশাপাশি বর্তমান বিজেপি’র নেতারাও কীভাবে চুরি-দুর্নীতিতে সরাসরি যুক্ত, তা উল্লেখ করে সেলিম বলেছেন, তৃণমূলের চুরির বিরুদ্ধে লড়াই তীব্র হতেই দেখা যাচ্ছে, শুভেন্দু অধিকারীর লোকদের নাম সামনে চলে আসছে। শিক্ষক নিয়োগে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়। ওখানে নিয়োগের তালিকা তৈরি হয়েছে তৎকালীন তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারীর সম্মতি ছাড়া? এনবিএসটিসি-কে ভেঙে ফেলা, ট্রাম তুলে দেওয়া, ট্রাম ডিপোর জমি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার পিছনে সেই সময়ের পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর হাত নেই? কাঁথির কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে কালো টাকার লেনদেন কে করতেন?
দার্জিলিঙ জেলায় পানীয় জল সহ একাধিক প্রকল্প চালুর বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মহম্মদ সেলিম বলেন, প্রকল্প শুধু ঘোষণাতেই আছে। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা ব্যানার্জি যত ফলক উন্মোচন করেছেন, সেগুলো কোথায়? তৃণমূল পাহাড়ের মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে, বিজেপিও ধোঁকা দিচ্ছে। মোদী সরকার ২০১৪ সাল থেকে আশ্বাস দিলেও উত্তরবঙ্গের চা বলয়ে পর্যটন শিল্প, বনজ সম্পদ, শিল্পায়ন, রেলের প্রকল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থা, চিকিৎসা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে কোনও প্রকল্পই আসেনি। পাহাড়ের মানুষ অসহায়। এখন অনিত থাপাকে সামনে রেখে তৃণমূল ঘুঁটি সাজানোর চেষ্টা করছে। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় পঞ্চায়েত, জিটিএ, পৌরসভার গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। মানুষ তৃণমূল এবং বিজেপি দুটো দলকেই ক্রমশ চিনে নিচ্ছেন। পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আগে নির্বাচন ঘোষণা হোক। মানুষের মেজাজ বুঝে ওরা এখন পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে চাইছে না। কিন্তু লড়াই জারি আছে, লুটেরাদের তাড়িয়ে মানুষের হাতে পঞ্চায়েত ফিরবেই।
Comments :0