নতুনপাতা : বইকথা
বাংলার ডাকাত: রহস্য, রোমাঞ্চকর ঘটনাবলির জীবন্ত দলিল
সৌরভ দত্ত
ছোটবেলায় মা, ঠাকুরমাদের থেকে শোনা হাড়হিম করা ডাকাতের গল্প। ঘুমপাড়ানি গল্প হিসেবে যেগুলো বিবেচিত।প্রতিটি ডাকাতের উত্থান ও সৃষ্টির পিছনে রয়েছে ঐতিহাসিক তথ্য। পরাধীন ভারতবর্ষে চুরি, ডাকাতি ছিল অন্যতম পেশা। গ্রন্থাগার এর সৌজন্যে সম্প্রতি হাতে এল দ্বেজ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত শ্রী ধীরেন্দ্রলাল রায়ের –“বাংলার ডাকাত” বইটি।বইটির ভূমিকাংশ লিখেছেন–শ্রী খগেন্দ্রনাথ মিত্র।বইয়ে স্থান পেয়েছে বাংলার ডাকাত ও ডাকাতদলের গল্প।গল্পগুলি অত্যন্ত সরস। প্রাণবন্ত।বাংলায় রঘু ডাকাতের গল্প লোকমুখে ঘোরে। সর্বজনবিদিত । উনিশ শতকের অরাজকতার সময়কালে বিদেশি বণিকরা বাণিজ্য করতে এসেছে ।তারা বাণিজ্যের নামে চুরি,জুয়া চুরির মাধ্যমে লুটতরাজ চালাত।এ সময়েই নীলকর সাহেবদের অত্যাচার চরমে ওঠে। চাষীদের বাধ্য করা হত ধান জমিতে নীলচাষ করতে।লেখক বলছেন–“তারা নির্বিবাদে এই অনাচার সহ্য করেনি,তারা প্রতিকারের জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিল।”লেখকের মতে–“দেশের এই গরিব-দুঃখীরা কিন্তু এই ডাকাতদের কাছ থেকেই নানাভাবে সাহায্য পেতো”।সপ্তগ্রাম অঞ্চলের রঘুনাথ আচার্যি ছিলেন এমনি এক ডাকাত।যিনি সংস্কৃত পাঠ শেষ করেছিলেন। বেদান্ত পড়েছিল।লাঠিখেলা, বল্লাম ছোড়ায় পারদর্শী ছিল।এ সময় পাঁচ কাটিয়া ,দশ কাটিয়া ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। চাষের যা খরচ উৎপাদিত নীলের দামে চাষীদের পোষাতে না।কেউ কুঠিবাড়িতে নিয়ে গিয়ে রঘুর বাবাকে মেরে অজ্ঞান করে দেয় রঘুর বাবার অবস্থা ভালো নয়।এরপর দুদিন অচেতন থেকে আচার্যি মশাই মারা গেলেন।এতেও–“রঘুনাথের চোখে জল নেই।”এরপর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রঘু রুখে দাঁড়ায়। তল্লাটে ঢেঁড়া পেটানো হয়।রঘু আচার্যির নামে পুরস্কার ঘোষিত হয়।রঘুর ডাকাতি শুরু হয়েছিল গরীব নিপীড়িত মানুষের জন্য।এর জন্য রঘুর হাজত বাস হয়।লুটের মাল নিয়ে রঘু দান ক্ষয়রাতি করত। থানার তালা ভেঙে পালানোর ঘটনাও ঘটে।“সবাইকার কাছে রঘু অলৌকিক শক্তিমান বলে মনে হয়।”এরপর রঘুনাথ এক রাতে থানা ও সাহেবদের নীলকুঠি পুড়িয়ে দেয়।এরপর বইয়ে রয়েছে শিবে ডাকাতের গল্প। “গাছতলায় বসে এক সন্ন্যাসী গাঁজা খাচ্ছে।”এরপর সাধুর কাছে এল এক বাউণ্ডুলে বাউল।এরপর দুজনে সাথী হয়ে উঠল।“সাধুজী , তোমার আর বেরুবার দরকার নেই।”একতারা আর ঝোলা নিয়ে বাউল বেরিয়ে পড়ল।বাউলকে গাঁয়ের চৌকিদার ধরেছিল। চৌকিদার বাউলকে বলে–“কোত্থেকে আসছিস্?নাম কী? কোথায় যাবি?” কারণ কদিন আগে নীলকুঠি লুট হয়েছে তাই নাকি শিবে ডাকাতের দলকে ধরিয়ে দিতে পারলেই মিলবে কড়কড়ে পাঁচশো টাকা পুরস্কার।গল্পে রয়েছে জমিদার বিজয় রায়ের সিন্দুক থেকে গহনা ও মোহর চুরির ইতিহাস।গল্পের শেষে দেখা যায়–“বাউল অট্টহাসি হাসলো।সে হাসি জমিদারের বুক অবধি কাঁপিয়ে দিল।”দেবীচরের বিল এর গল্পকাহিনিটিও বেশ রোমাঞময়।এই বিলের চরও একদিন কেঁপে উঠেছিল।দুই লাঠিয়ালের দাঙ্গায়। “বিলের দু’পাশে দুই জমিদার–এপাশে আমড়াতলা ওপাশে মাহমুদপুর।”গোড়াতেই দেখা যায় একটা সড়কি মাহমুদুরের সর্দার রাম দোলাইয়ের বুক ফুঁড়ে দেয়।“মামুদপুরের এবার দুর্ভাগ্য,উপরি উপরি ক’বছর তারা বিল ভোগ করে আসছে–এবার আর তার হলো না” বইয়ের লালনীল গল্পটিও উল্লেখযোগ্য।প্রতিটি গল্পে রয়েছে নীলকুঠি ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচার। শংকরদাস নীলকুঠির গোমস্তা। শংকর জাতি-ধর্ম ত্যাগ করেছিল। সাতখানা গাঁয়ে ভৈরবতলায় টোলচতুষ্পাটীর নাম ছিল।অভাবের জন্য সেই টোলচতুষ্পাটী উঠে গেছে। শিবদাস লেখাপড়া জানা মানুষ,বামুন পণ্ডিত বলে গাঁয়ে তাঁর ক্ষাতি আছে। কুঠিবাড়িতে পাইক এসেছিল। গাঁয়ের লোকেদের ধরে নিয়ে গেল।কারণ দশ বিঘা জমিতে নীল চাষ করার হুকুম পালন না করার জন্য।নাটবারান্দায় বসে শিবদাস নীলকুঠির অনাচারের কথা সব বললেন! নীলকরদের জুলুম বাড়ছিল।শিবদাসের চালায় লেঠেলরা আগুন ধরায়। সাতগাঁ অঞ্চলে এই অমিয় ‘ওমে সর্দার’ নামে খ্যাতি লাভ করে। মানুষ একদিন জন সাহেবের ঘরে অগ্নি সংযোগ করে। রহস্যময় রোমাঞ্চকর গল্পে দেখা যায় –গান্ধীজী, জওহরলাল ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তার এর ঘটনায় সারা ভারতে গণবিক্ষোভ দেখা যায়। এখানে দেবেশ বাবু আকস্মিক মৃত্যু ঘটে বোতল বোমায়। কয়েকটি চিঠির বর্ণনা। বইয়ের শেষ পর্যন্ত গল্প কুয়াশা লোহার কারবারি সুখলাল।যে ধরা পড়ার ভয়ে ব্যাঙ্কে রাখত না। আলমারি খুলে একদিন সুখলাল চমকে ওঠে দেখে আলমারিতে রাখা নেকলেসের বাক্স নেই। গল্পের শেষে দেখা যায়–“কিছুদিন যাবৎ কলকাতার যত হীরে-জহরৎ লুঠ হয়েছিল সবাই পাওয়া গেল শরৎবাবুর ঘরের ওই কাঠের পুতুলগুলির ভিতর থেকে।” বইটিতে তৎকালীন সময়ের চুরি,ডাকাতির কৌশল ও বিভিন্ন অজানা ঘটনা ফুটে উঠেছে। বেশিরভাগ গল্পের পটভূমি নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে গরীব মানুষের লড়াই ।
বইয়ের নাম–বাংলার ডাকাত
লেখক–শ্রী ধীরেন্দ্রলাল ধর
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ–ধীরেন শাসমল
প্রকাশক–দ্বেজ পাবলিশিং
Comments :0