নতুন বন্ধুর কলমে
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সাঁঝবাতি পাল
একদিন এক যুবক কলেজে গিয়ে বন্ধুদের বললো..."দেখ দেখি,কিরকম চুল কাটিয়াছি? ইহার জন্য আমার একটি মোহর ব্যয় হইয়াছে"
বন্ধুরা কেবল অবাক নয়,হাসাহাসি ও করলো।এ তো নতুন কিছু নয়,ইংরেজদের মত চুল কাটতে একটা মোহর খরচ!
যুবকটির নাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত।জন্ম ২৫ শে জানুয়ারি,১৮২৪,সাগরদাঁড়ি গ্রামে।বাবা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন অবস্থাপন্ন উকিল।মা জাহ্নবী দেবী ছিলেন তাঁর ছেলেবেলার অন্যতম সঙ্গী।লাজুক প্রকৃতির মধুসূদন মা ছাড়া জানতো না কিছুই।
তখন ইংরেজদের আমল,ইংরেজি শিক্ষার যুগ।প্রায় অনেক শিক্ষিত যুবকের মত তাঁরও মনে হয়েছিল ইংরেজি সাহিত্যই শ্রেষ্ঠ।এছাড়াও কারণ ছিল অনেক,সুরেশচন্দ্র মিত্রের মতে, তখন হিন্দু কলেজে বাংলা চর্চার কোনো পরিবেশ ছিল না।তবে তখন তিনি বাংলা পড়তেন না তা নয় তবে বাংলায় লেখেননি এক কলমও।শিক্ষক রিচার্ডসনকে দেখে তিনি অনুপ্রানিত হয়েছিলেন।তাঁর মাধ্যমেই ইংরেজি সাহিত্যরসিক হয়ে ওঠেন মধু।তাই তখনই ঠিক করেছিলেন তিনি কবি হবেন।খুব বড় কবি।
আর তাঁর এই স্বপ্ন যেন পাগল করে বেড়াত তাঁকে।কেবল ইংরেজি সাহিত্যচর্চাই নয়,মধু অনুকরণ করতেন ইংরেজদের হাঁটা-চলা,পোশাক,খাদ্যাভ্যাস এমনকি তাঁর প্রিয় শিক্ষক রিচার্ডসনের হাতের লেখাও।তাই যুবক মধুসূদনের মনে হয়েছিল এই সাহিত্যে কবি হতে গেলে সাহিত্যিকদের ধর্মাবলম্বন করাও জরুরি।তাই ধর্মের ঔৎসুক্যে নয়,স্বপ্নের সন্ধানে মধু ১৮৪৩ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করলেন।মধুসূদনের ধর্মান্তরের অর্থ জাত্যন্তর নয়। এর বিপক্ষে সমালোচকদের তর্ক উড়িয়ে দেওয়া যায় একটা চিঠি পড়ে।যেখানে প্রিয় বন্ধু গৌরদাস মধুকে লিখেছিলেন "To Christian M. S. Dutt from G. D. B." যার উত্তরে মধু জানান "I do not like it.You ought to adress me M. Dutt Esqr. or Baboo"
এরপরেই বাবার দ্বিতীয়বার বিবাহ,কলকাতায় চাকরির অভাব,পরিবার থেকে অর্থসাহায্য প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে অশান্তি ও উৎকন্ঠায় মধুসূদন মাদ্রাজে পাড়ি দিলেন।ফিরে এলেন ছয় বছর পর।
মাদ্রাজের এককালীন শিক্ষক কলকাতায় এসে দোভাষী পদে নিযুক্ত হলেন।এরপরই যেন শুরু হলো প্রস্ফুটনের যুগ।একের পর এক রচিত হলো 'শর্মিষ্ঠা' 'পদ্মাবতী' 'কৃষ্ণকুমারী' 'একেই কি বলে সভ্যতা','বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' এই পাঁচটি নাটক।বলা হয় "কোনোটিই পূর্ব রচনার অনুকরণ নয়,কোনোটিই পূর্ব সাহিত্যিকদের রচনার মত 'অনুবাদ' নয়"। এছাড়াও অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখলেন 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য'। এই ছন্দ আরও পরিণতি পেয়েছিল 'মেঘনাদবধ কাব্যে'।
এরই মধ্যে মধুসূদন বিয়ে করেছিলেন ফরাসি মহিলা হেনরিয়েটাকে।প্রায় আটত্রিশ বছর বয়সে মধুসূদন স্থির করলেন বিদেশে যাবেন।তবে ছেলেবেলার ধারণা অনুযায়ী কবি হওয়া এ যাত্রার উদ্দেশ্য নয়। তিনি লিখলেন "আমার কবিজীবন আজ সমাপ্তির মুখে।ব্যারিস্টারী পড়ার জন্য আমি বিদেশ যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছি।"
পৈত্রিক গৃহ বিক্রি করে,সম্পত্তি বন্ধক রেখে,স্ত্রী,পুত্র,কন্যাকে দেশে রেখে মধুসূদন ইংল্যান্ড যাত্রা করলেন।যাত্রার পূর্বে বন্ধু রাজনারায়নকে চিঠিতে লিখে পাঠালেন,একটি কবিতা,তাঁর জন্মের দুশো বছর পরেও সে কবিতা আজও অবিস্মরণীয়..."জন্মভূমির প্রতি"।
কিন্তু এরপরই যেন দুঃখের দিন শুরু হলো মধুসূদনের।দেশে যাঁদের কাছে সম্পত্তি বন্ধক রেখে গিয়েছিলেন,তাঁরা হঠাৎই টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন।অনেক চিঠি লিখেও কোনো উত্তর পেলেন না তিনি।অবশেষে অর্থাভাবে অনাথের একমাত্র আশ্রয় বিদ্যাসাগরের শরণাপন্ন হলেন।শুধু সেবারই নয়,বিদেশে থাকাকালীন বারবার টাকা পাঠিয়ে বিদ্যাসাগর সাহায্য করেছিলেন তাঁকে। এভাবেই নানা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ব্যারিস্টারী পড়া শেষ করলেন মধুসূদন।সেই সংগ্রাম এতই যন্ত্রণাদায়ক ছিল কবি লিখেছিলেন "সঙ্গে আমার শিশুসন্তানগুলি না থাকত,স্ত্রী না থাকতেন,তাহলে আমি আত্মহত্যা করে বসতাম'।
ব্যারিস্টার হয়ে তিনি দেশে ফিরেও স্বস্তি পেলেন না।হাইকোর্টে প্রবেশ করা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে উঠলো।কমাস পরে সেই সুযোগ হলেও ব্যারিস্টারী জীবন তাঁর সুখের হয়নি।অন্যদিকে কবির বিশৃঙ্খল জীবনযাপনে আবার অর্থাভাব দেখা গিয়েছে।আদালতের চাকরি চলে যাওয়ার পর তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন।তবু চারিদিকে যেন বিশৃঙ্খলা।বাড়ি ভাড়া বাকি,ভৃত্যদের বেতন বাকি,মুদিখানায় বাকি। স্ত্রী হেনরিয়েটাও প্রবল অসুস্থ।
ব্ন্ধুরা কবিকে এনে আলিপুর দাতব্য চিকিৎসালয়ে ভর্তি করলেন।মাত্র ৩৯ বছর বয়সে স্ত্রী হেনরিয়েটা মারা গেলেন। ঠিক তার আটদিন পরেই ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ২৯শে জুন রবিবার কবিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।ব্ন্ধু নবীন সেন কবিতায় লেখেন
"অযত্নে মা অনাদরে
বঙ্গ কবি কুলেশ্বরে,
ভিক্ষুকের বেশে মাতঃ দিয়েছ বিদায়।"
কবির মৃত্যুর পর তাঁকে সমাধিস্থ করার জায়গা দিতে চাননি অনেকেই।অবশেষে লোয়ার সার্কুলার রোডে স্ত্রী-র পাশেই কবির দেহ সমাধিস্থ হলো।বহুবছর পর তাঁর বন্ধুরা তাতে এক স্মৃতিফলকের ব্যবস্থা করেন।তাতে এখনও উজ্জ্বল তাঁরই লেখা কবিতা...
"দাঁড়াও,পথিকবর!
জন্ম যদি তব বঙ্গে,তিষ্ঠ ক্ষণকাল।
এ সমাধিস্থলে।"
সাঁঝবাতি পাল
রানী বিনোদ মঞ্জরী রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়
দ্বাদশ উত্তীর্ণ
রঘুনাথপুর, ঝাড়গ্রাম, জঙ্গল মহল
ফোন - ৮৬৩৭৩৫৬৯৯৭
Comments :0