আকাঙ্খার বৈশাখ
সাঁঝবাতি পাল
কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন..
"কাল বৈশাখী আসেনি হেথায়,আসিলে মোদের তরুশিরে
সিন্ধু শকুন বসিত না আসি,ভিড় করে আজ নদীতীরে"
একথা আজও ভীষণ সত্য। হয়তো তাই যে বাঙালি পয়লা বৈশাখ বলতে কেবল ক্যালেন্ডার, মিষ্টির প্যাকেট আর নতুন কাপড় বুঝতো তারাই আজ নিরুপায় হয়ে প্রশ্ন করেছে.."ব্ঙ্গাব্দ ,তুমি কার?" কারণ সেই শকুনদের দল থেকে কে যেন হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠেছে.."পয়লা বৈশাখ হিন্দুদের উৎসব"।
বঙ্গাব্দের প্রবর্তক কে? শশাঙ্ক নাকি আকবর? সেই নিয়ে ঐতিহাসিকদের ধন্দ এখনও না কাটলেও শকুনপক্ষ শুরু করে দিয়েছে তোড়জোড়।এই পয়লা বৈশাখে কলকাতায় আয়োজিত হচ্ছে এক অন্যরকম 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'।তাতে থাকবে কীর্তন গাইয়ে,শ্রীখোল বাদকের দল,হিন্দু রাজা শশাঙ্কের নামাঙ্কিত ট্যাবলো।কীর্তন খোল বাজিয়ে একাডেমি অব ফাইন আর্টস থেকে তারা ছড়িয়ে দেবে হিন্দুত্বের বাণী।আর হয়তো এভাবেই পয়লা বৈশাখের রং ও ক্রমশ গেরুয়া হয়ে উঠবে!
অথচ জানেন এই মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাসটা একেবারে অন্যরকম...১৯৮৯ সাল থেকে বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের উৎসবে এক অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা।সকল জাতি -ধর্ম -শ্রেণী- পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন এই শোভাযাত্রায়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে "মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য" হিসেবে ঘোষণা করে।
সেই মানবতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ধর্ম আজ উৎসবে মেতেছে।তাই শকুনপক্ষের দাবি মেনে বঙ্গাব্দ আদতে কার তা জানতে যদি আরেকটু ইতিহাস পড়ে ফেলি...জানতে পারবেন..মুঘল আমলে ভারতে মুঘল সম্রাটরা কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতো হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে। কিন্তু তা কৃষি ফলনের সাথে মিলতো না।তাই খাজনা আদায়ের সময়কালে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ এই গণনা শুরু করেন।তবে এই পদ্ধতি কার্যকর হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ই নভেম্বর অর্থাৎ আকবরের সিংহাসনে আরোহনের সময় থেকে।সেই সময়ই শুরু হয় পহেলা বৈশাখ উদযাপন। জানা যায় চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা ,মাশুল ,শুল্ক পরিশোধ করতো চাষিরা এবং পরদিন ভুমিমালিকরা নিজ এলাকার অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন।এমনকি তৈরি হতো নতুন হালখাতাও।এই রীতি নবাব মুর্শিদ কুলি খানের মাধ্যমে পালিত হয় বাংলাতেও। নবাব যার নাম দেন "পুণ্যাহ" যার অর্থ "ভূমি রাজস্ব আদায়ের উৎসবের দিন"। ঐতিহাসিকরা বলেন আকবরের সময়কালে দুটো শিবমন্দিরে পাওয়া যায় 'বঙ্গাব্দ' শব্দটি। তবে প্রথমে এর নাম ছিল তারিখ-ই-ইলাহী। পরে পরে সম্রাটের পন্ডিত, বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদদের সহায়তায় এতে বারোটি মাস যুক্ত হয়। অনুমান করা হয় ,এই বারোটি মাসের নাম পরবর্তী কালে রাখা হয় বারোটি নক্ষত্রের নামানুসারে,যেমন..বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ, ভদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বায়িনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, আগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ণ, পউস্যা থেকে পৌষ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র।
কিন্তু কথায় আছে না? "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু,তর্কে বহুদূর" এরপরও বঙ্গাব্দের প্রবর্তক কে তা নিয়ে রয়েছে নানান ধন্দ।তাই শশাঙ্ক নাকি আকবর ? আমাদের নাকি ওদের? এই প্রশ্নের বাইরে গিয়ে আমরা কি পারিনা উৎসবের প্রাঙ্গনকে আরও বড় করে তুলতে,যাতে এই শকুনের দল তা ছেয়ে ফেলতে ব্যর্থ হয়। এই বৈশাখ করে তুলুন নজরুলের সেই আকাঙ্খার বৈশাখ,কবি ফররুখের সেই কালো ঘোড়া,যার খুরের আঘাতে ধ্বংস হয় সকল জরাজীর্ণতা। কবিগুরুর ভাষায় বলতেই পারেন...
"দুঃখসুখ আশা ও নৈরাশ
তোমার ফুৎকার ক্ষুব্ধ ধুলাসম উড়ুক গগনে,
ভরে দিক নিকুঞ্জের স্খলিত ফুলের গন্ধ-সনে
আকুল আকাশ-
দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ।
ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ!"
নতুনবন্ধু
সাঁঝবাতি পাল
দ্বাদশ শ্রেণী
রানী বিনোদ মঞ্জরী রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয় , রঘুনাথপুর, জঙ্গলমহল, ঝাড়গ্রাম
৮৬৩৭৩ ৫৬৯৯৭
Comments :0