মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এবং তারপরেও সুস্থ থাকাকালীন প্রতিদিন নিয়ম করে সিপিআই(এম)’র রাজ্য দপ্তর মুজফ্ফর আহ্মদ ভবনে আসতেন কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শুক্রবার সেই মুজফ্ফর আহ্মদ ভবন থেকেই তাঁর মরদেহ নিয়ে শেষযাত্রায় শামিল হলেন অগণিত মানুষ। সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের পরেও হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন তাঁকে শেষ বিদায় জানানোর জন্য। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডকে জনপ্লাবিত করে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মরদেহ পৌঁছয় এনআরএস হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে। সেখানেই তাঁর দেহদান করা হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের চর্চার জন্য।
বৃহস্পতিবার কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মরদেহ রাখা হয়েছিল পিস ওয়ার্ল্ডে। শুক্রবার সকাল সাড়ে দশটার পর সেখান থেকে মরদেহ বের করে নিয়ে যাওয়া হয় বিধানসভায়। সেখানে অধ্যক্ষ, মন্ত্রী, বিধায়কদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পরে দুপুর বারোটায় মরদেহ নিয়ে আসা হয় সিপিআই(এম)’র রাজ্য দপ্তর মুজফ্ফর আহ্মদ ভবনে। কলকাতায় চলে এসেছিলেন পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্যরা। পার্টির প্রবীণ নেতা বিমান বসু, রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং পলিট ব্যুরোর সদস্য প্রকাশ কারাত, বৃন্দা কারাত, মানিক সরকার, এম এ বেবি, নীলোৎপল বসু, মানিক সরকার, সূর্য মিশ্র, রামচন্দ্র ডোম, তপন সেন, প্রবীণ নেতা হান্নান মোল্লা মরদেহে লাল পতাকা বিছিয়ে দেন। তারপরে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দও মাল্যদান করেন। শুধু সিপিআই(এম) নয়, বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির নেতৃবৃন্দ, অন্যান্য বামপন্থী দল এবং কংগ্রেস, বিজেপি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও মাল্যদান করেছেন। বিভিন্ন বামপন্থী গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্ত্রিসভায় কাজ করা অনেক প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তাঁর অধীনে কাজ করা প্রাক্তন আমলা, শিক্ষা ও শিল্প সংস্কৃতি জগতের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিও পার্টির রাজ্য দপ্তরে এসে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ এসেছিলেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। এদিন মুজফ্ফর আহ্মদ ভবনে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে এবং শেষযাত্রায় ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য এবং সন্তান সুচেতন ভট্টাচার্যও। বৃহস্পতিবার রাতেই মীরা ভট্টাচার্যকে ফোন করে শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন কংগ্রেস নেতা ও লোকসভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী।
কলকাতায় এদিনই শুরু হয়েছে সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় জেনারেল কাউন্সিল সভা। তা মুলতবি রেখে সভায় অংশগ্রহণকারী চারশো জন নেতৃস্থানীয় সংগঠক মুজফ্ফর ভবনে এসে কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মরদেহে মাল্যদান করেছেন।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে তখন লোকারণ্য। অপেক্ষারত মানুষের লাইন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড হয়ে চলে গেছে মৌলালি ছাড়িয়ে। কেউ হাতে ফুল নিয়ে, কেউ কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছবি হাতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেছেন। অনেকে সাতসকালেই বাড়ি থেকে রওনা হয়ে অনেক দূর থেকে এসেছেন। এমনকী সারা রাত ট্রেনযাত্রা করে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি থেকেও অনেকে এসেছেন। ‘কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে শেষবার চোখে দেখা’র তাগিদ এভাবেই রাজ্য জুড়ে কাজ করেছে। গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের কর্মী থেকে সরকারি চাকরিজীবী, বার্ধক্যে জর্জরিত স্মৃতিবিধুর বৃদ্ধবৃদ্ধা কিংবা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণী, এদিনের শেষ যাত্রায় শামিল মানুষের মধ্যে গোটা সমাজের বৈচিত্রই ছিল। জিজ্ঞাসা করলে প্রায় সবাই জানাচ্ছিলেন তীব্র আপশোসের কথা। রাজ্যকে গড়ে তোলায় কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্বপ্ন অপূর্ণ থাকার আপশোস।
মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্ত্রিসভার সহকর্মী প্রবীণ অসীম দাশগুপ্ত, অশোক ভট্টাচার্য, রেখা গোস্বামী, দেবলীনা হেমব্রম, অঞ্জন বেরা, সিপিআই(এম) নেতা শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, রবীন দেব, অমিয় পাত্র, সুজন চক্রবর্তী, আভাস রায়চৌধুরি, অঞ্জু কর, অনাদি সাহু, জীবেশ সরকার, জিয়াউল আলম, সুমিত দে, গণশক্তির সম্পাদক শমীক লাহিড়ী, দেশহিতৈষীর সম্পাদক পলাশ দাশ, নন্দন পত্রিকার সম্পাদক অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী, সিপিআই’র সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা, মঞ্জুকুমার মজুমদার, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, রাজ্য সম্পাদক তপন হোড়, ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রবীণ নেতা দেবব্রত বিশ্বাস, রাজ্য সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি, কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য, আবদুল মান্নান, অসিত মিত্র, নেপাল মাহাতো, আইএসএফ বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতা কার্তিক পাল, পার্থ ঘোষ, বাসুদেব বসু, এসইউসিআই নেতা চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, অশোক সামন্ত, তরুণ মণ্ডল, তরুণ নস্কর, বিজেপি নেতা তাপস রায়, শিশির বাজোরিয়া, সমাজবাদী পার্টির নেতা কিরণময় নন্দ প্রমুখ। পশ্চিমবঙ্গ জনতা দল, সিপিআই(এমএল) কানু সান্যাল গোষ্ঠী ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি চোখের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আসতে পারেননি, তাঁর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের পক্ষ থেকে প্রেরিত মালাও দেওয়া হয়েছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে।
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক মারিয়াম ধাওয়ালে, রাজ্য সম্পাদক কনীনিকা ঘোষ, রাজ্য সভানেত্রী জাহানারা খান, ডিওয়াইএফআই’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিমঘ্নরাজ ভট্টাচার্য, এসএফআই’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস প্রমুখও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।
শিল্প ও সংস্কৃতি জগতের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিও এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে। চন্দন সেন, বিমল চক্রবর্তী, সব্যসাচী চক্রবর্তী, দেবশঙ্কর হালদার, শঙ্কর চক্রবর্তী, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, দেবদূত ঘোষ, উষসী চক্রবর্তী, রাহুল অরুণোদয় ব্যানার্জি, সৌমিত্র মিত্র, জয়রাজ ভট্টাচার্য, সৌরভ পালোধি, সুদীপা চট্টোপাধ্যায়, পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সঙ্গীত শিল্পী উষা উত্থুপ, পূর্ণদাস বাউল এবং আরও অনেকে এসে প্রয়াত জননেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল শ্যামল সেন, কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তী, রাজ্যের মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়, কমরেড জ্যোতি বসু ও কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়ের প্রেস সচিব সরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গাড়ির চালক মহম্মদ ওসমান প্রমুখও শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ ভবনে। কলকাতা প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস শূর, কলকাতা জার্নালিস্ট ক্লাবের সভাপতি প্রান্তিক সেন সহ ইস্টবেঙ্গল ক্লাব এবং বিভিন্ন ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংস্থা, কলকাতা জাপান কনস্যুলেট অফিস ইত্যাদির প্রতিনিধিরাও এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে। ডলি বসু, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা তিতি রায়, সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, কমরেড অনিল বিশ্বাসের স্ত্রী গীতা বিশ্বাস, কমরেড নিরুপম সেনের স্ত্রী চন্দ্রাবলী সেন প্রমুখও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
জনস্রোতের মতো মানুষ রাজ্য দপ্তরে ঢুকে প্রয়াত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। অপরিসর স্থানে প্রচণ্ড ভিড়ে এবং গরমে কয়েক জন অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তবুও শেষ দেখার চেষ্টা ছাড়েননি কেউ। শেষে পরিস্থিতি এমন হয় যে, দুপুর সাড়ে তিনটের সময়েও বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারতদের বিশাল লাইন। এই অবস্থায় তাঁদের বাইরে দাঁড়িয়ে শেষ যাত্রায় শামিল হয়ে শ্রদ্ধা জানাতে অনুরোধ করা ছাড়া উপায় ছিল না নেতৃবৃন্দের। ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের সঙ্গে পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্যরা কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মরদেহ তুলে দিলেন শকটে। স্লোগান উঠলো, ‘কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অমর রহে’, ‘কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য লাল সেলাম’। শেষযাত্রার মিছিল এগিয়ে চলল আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড ধরে। অগণিত মানুষের লাল সেলামে বিদায় নিলেন কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
Last rite of Buddhadeb Bhattacharya
একবার চোখে দেখার আশায় দীর্ঘ অপেক্ষা
×
Comments :0