সংসদে একক গরিষ্ঠতাহীন বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন তৃতীয় মোদী সরকার যে দু’টি ক্রাচের উপর দাঁড়িয়ে আছে, নিজের সপ্তম বাজেটে তা স্পষ্ট করে দিলেন কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। মঙ্গলবার তিনি লোকসভায় পেশ করেছেন ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের পূর্ণাঙ্গ বাজেট। তাঁর বাজেটে বর্তমান মোদী সরকারের অন্যতম ক্রাচ জেডি(ইউ)-শাসিত বিহার পেল প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্যাকেজ, একইভাবে আরেক ক্রাচ টিডিপি-শাসিত অন্ধ প্রদেশ পেয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ। সেই সঙ্গেই বাজেটে নতুন আয়কর কাঠামোয় মধ্যবিত্তর জন্য কর ছাড়ের সীমা সামান্য বাড়িয়ে বার্ষিক ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়কে করা হলো করশূন্য ও সাধারণ ছাড়ের পরিমাণ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে করা হলো ৭৫ হাজার টাকা। কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহার ন্যায় পত্র খানিকটা অনুসরণ করে তিনি বাজেটে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত বেতনে নিযুক্ত নতুন কর্মীদের এক মাসের বেতন সরকার দেবে বলে জানিয়েছেন। এই প্রকল্পে দেশে কর্মসংস্থানে জোয়ার আসবে বলে দাবি করেছেন অর্থ মন্ত্রী। তবে তিনিই আবার গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রকল্প রেগা বা একশো দিনের কাজের প্রকল্পকে বাজেট ভাষণে রেখে দিয়েছেন বঞ্চনার জায়গায়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের চড়া মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ জেরবার হলেও এবারের বাজেটে কমানো হয়েছে খাদ্যে ও সারে ভরতুকি। তারপরেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যথারীতি প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলেছেন, এই বাজেট দেশের গরিব মানুষ, গ্রাম এবং কৃষককে উন্নতির পথে নিয়ে যাবে। বিপরীতে বিরোধী দলগুলি কটাক্ষ করে বলেছে, দেশের আসল সমস্যার সমাধানের রাস্তা খোঁজার দিকে না গিয়ে শরিকদের তুষ্ট করে মোদীর কুর্সি বাঁচানোর পথে হেঁটেছে বাজেট।
বিজেপি’র কাছে যে জেডি(ইউ) এবং টিডিপি-কে খুশি রেখে নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রীর আসন ধরে রাখা বড় দায়, এদিনের বাজেটে তা খোলসা করে দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এবারের বাজেটে তাই তিনি দৃষ্টিকটু হলেও কার্যত উদার হাতে দুই রাজ্যের জন্য বিপুল অর্থ বরাদ্দ করেছেন। বিহারের প্রধান শাসক দল জেডি(ইউ) এবং অন্ধ্র প্রদেশের প্রধান শাসক দল টিডিপি কেন্দ্রের বর্তমান এনডিএ সরকারের অন্যতম শরিক। মোদী তথা বিজেপি-কে সমর্থনের বিনিময়ে দুই দলের প্রধান যথাক্রমে নীতীশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডু নিজ নিজ রাজ্যের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের দাবি জানিয়েছিলেন। বাজেটে দেখা গেল তারই প্রতিফলন। বিহারে নতুন বিমানবন্দর, সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, মেডিক্যাল কলেজ, ক্রীড়া পরিকাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ঘোষণা করে সেগুলির জন্য ২৬ হাজার কোটি টাকা এবং রাজ্যের বন্যা নিয়ন্ত্রণে আরও সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটে। অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী অমরাবতীর পরিকাঠামো নির্মাণেও ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটে। পাশাপাশি মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার গরিব মানুষের জন্য বিশেষ সুরাহার কথা না বলা হলেও মধ্যবিত্তকে নতুন আয়কর কাঠামোয় ছাড় বাড়িয়ে খুশি করার চেষ্টা করেছেন অর্থ মন্ত্রী। বাজেটে বলা হয়েছে, যাঁরা নতুন আয়কর কাঠামো বেছে নিয়েছেন, তাঁদের বার্ষিক ৩ লক্ষ পর্যন্ত আয়ে কোনও কর দিতে হবে না। তাঁদের ক্ষেত্রে সাধারণ ছাড়ের পরিমাণও ৫০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হবে ৭৫ হাজার টাকা। ব্যক্তির মোট আয় থেকে এই ছাড় বাদ দিয়েই প্রাথমিক করযোগ্য আয় নির্ধারণ করা হয়। নতুন কাঠামোয় আয়ের বিভিন্ন সীমায় আয়করের হারেও কিছুটা রদবদল করা হয়েছে বাজেটে। প্রসঙ্গত, এই নতুন আয়কর কাঠামোয় বিমা সহ নানাবিধ সঞ্চয় ও ঋণ বাবদ কোনও ছাড় পাওয়া যায় না করযোগ্য আয়ে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে ব্যয় যখন প্রবল বেড়েছে, তখন আয়কর ছাড়ের সীমা বাড়িয়ে ৩ লক্ষ টাকা করা হলেও মূল্যবৃদ্ধির বোঝা সামলানোর ক্ষেত্রে করছাড় বাবদ বাড়তি আয় বিশেষ কাজে আসবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। ফলে তাঁরা বেশিরভাগই বাড়তি আয় খরচ করে পণ্যসামগ্রী বেশি কেনার দিকে ঝুঁকবেন না। তার মিলিত প্রভাবে সারা দেশেই নতুন চাহিদা তৈরি হবে না।
বস্তুত, এবারের বাজটে অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরি করার পদক্ষেপের বদলে জোগান বাড়ানোর উপরেই মূল জোর দেওয়া হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, সেখানেই বাজেটের সমস্যা। কারণ, চাহিদা না বাড়লে উৎপাদন বাড়ে না। আর উৎপাদন না বাড়ানো গেলে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হওয়ার জায়গা নেই। ফলে অর্থ মন্ত্রী সর্বাধিক এক লক্ষ টাকা বেতনে নতুন নিয়োগে সরকারের পক্ষ থেকে এক মাসের বেতন দেওয়ার কথা বললেও অর্থনীতিতে চাহিদা যদি না বাড়ে এবং কোম্পানিগুলি যদি উৎপাদন ক্ষমতা সেই কারণে একই রেখে দেয়, তাহলে কর্মীসংখ্যা বাড়িয়ে কোন কোম্পানি তার মুনাফার মাত্রা কমাতে চাইবে? উল্লেখ্য, প্রথম বার চাকরিতে ঢুকবেন যাঁরা, তাঁরা বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাবেন বলে বাজেটে ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রী। আবার তাঁদের চাকরিতে নিয়োগ করবে যেসব কোম্পানি, ওই সব কর্মীর প্রভিডেন্ট ফান্ড খাতে সেগুলিকেও আর্থিক সুবিধা দেবে সরকার। সীতারামন এর নাম দিয়েছেন এমপ্লয়মেন্ট লিঙ্কড ইনসেনটিভ বা কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত উৎসাহভাতা। তিনি জানিয়েছেন, এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত বেতনে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনভাবে দেওয়া হবে এই অর্থ। প্রথমত, সরাসরি এক মাসের বেতন পৌঁছে দেওয়া হবে। ইপিএফও-তে নাম নথিভুক্ত হলে তিনটি কিস্তিতে ওই টাকা সরকার সেখানে জমা করবে। দ্বিতীয়ত, উৎপাদন ক্ষেত্রে নবনিযুক্ত কর্মী এবং নিয়োগকারী সংস্থার ভাগের ইপিএফও’র টাকা প্রথম চার বছরের জন্য সরকারই দেবে। তৃতীয়ত, প্রতি অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থা প্রথম দু'বছর প্রভিডেন্ট ফান্ডে দেয় অর্থ বাবদ মাসে যে ৩০০০ টাকা জমা দেবে, তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে তাদের। কিন্তু নিয়োগের ১২ মাসের মধ্যে ওই কর্মী চাকরি ছেড়ে দিলে সরকারের ঘরে সেই টাকা ফিরিয়ে দিতে হবে ওই সংস্থাকে। অর্থ মন্ত্রীর দাবি, এর ফলে কোম্পানিগুলি নতুন কর্মী নিয়োগে উৎসাহিত হবে এবং তার পরিণতিতে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে। একেই কংগ্রেস তাদের ন্যায় পত্রের অ্যাপ্রেনটিসশিপ স্কিমের নকল বলে কটাক্ষ করেছে। ন্যায় পত্রে কংগ্রেস বলেছিল, তারা ক্ষমতায় এলে আইন তৈরি করে ২৫ বছরের কম বয়সী স্নাতকদের এক বছরের অ্যাপ্রেনটিসশিপের অধিকার দেবে। যে কোনও কাজের জায়গায় তারা শিক্ষানবীশ হিসাবে যোগ দিতে পারবেন এবং তার জন্য বছরে তারা এক লক্ষ টাকা পাবেন, যে অর্থ সরকার তাদের দেবে। স্পষ্টতই সীতারামনের ঘোষিত প্রকল্প এমন সুস্পষ্ট বার্তা দেয়নি। কারণ, কংসগ্রেস যেখানে আইন তৈরি করে বেকারদের কাজের অধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, মোদীর এনডিএ সরকার সেখানে প্রশাসনিক নির্দেশে প্রকল্প রূপায়নের কথা বলেছে। শুধু তা নয়, সীতারামন তাঁর এই প্রস্তাবের বাস্তবায়নের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়েছেন এমপ্লয়ার অর্থাৎ নিয়োগ কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ মালিকদের হাতে। যদি তারা নিয়োগ করে, তবেই সরকারের দিক থেকে নতুন নিযুক্তদের এক মাসের বেতন বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেওয়ার প্রশ্ন আসবে। তিনি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন, বেকারত্বের মোকাবিলায় সরাসরি দায়িত্ব নেবে না সরকার।
অর্থ মন্ত্রী অবশ্য বাজেটকে জনমুখী বোঝাতে শব্দ ব্যবহারে আগের ছয় বারের মতো কোনও কার্পণ্য করেননি এবারও। তিনি বলেছেন, ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ব্যতিক্রমী ঔজ্জ্বল্য দেখাচ্ছে। এই বাজেটে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে কর্মসংস্থান, দক্ষতা বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র-মাঝারি-অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগ এবং মধ্যবিত্তর উপরে। তিনি বাজেটে ৯টি ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও বলেছেন। এগুলি হলো উৎপাদনশীলতা, চাকরি, সামাজিক ন্যায়, নগরোন্নয়ন, পরিবেশ-উপযোগী কৃষিবীজ নিয়ে গবেষণা, জ্বালানির নিরাপত্তা, পরিকাঠামো, উদ্ভাবন এবং সংস্কার। কিন্তু তাঁর বাজেট বক্তৃতায় না এসেছে রেগার কথা, না তিনি একটি শব্দও খরচ করেছেন রেল নিয়ে। শুধু বাজেটের সংযোজিত অংশে রেলের বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ উল্লেখ করা হয়েছে। রেলের মতো ভারতীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র এবং মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের গভীর সমস্যার প্রতি এহেন অবহেলাই বুঝিয়ে দিল, শেষ পর্যন্ত এনডিএ সরকারের কাছে বাজেট কিছু চমক দেওয়ার বার্ষিক আয়োজন ছাড়া আর কিছু নয়।
Comments :0