Painter Rabin Dutta Post Editorial Ganashakti

প্রতিবাদের চিত্রশিল্পী রবীন দত্ত

সম্পাদকীয় বিভাগ

Painter Rabin Dutta Post Editorial Ganashakti

বছর দুয়েক আগে হঠাৎই রবীনদার ফোন আমি দিল্লি যাবো ঠিক করেছি, তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে? বললাম, কেন রবীনদা? বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন— কেন কি গো! দে‍‌শের কৃষকরা কি কাণ্ডটাই করছে দেখছো না? কৃষকরা দেশের শাসকদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা সারাজীবন ধরে এই স্বপ্নটাই তো দেখে এসেছি। এই ঘটনা আমার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবো এটা কখনো ভাবিনি। তাই ঠিক করেছি আমি দিল্লি যাবো, ওখানে আন্দোলনের ছবি আঁকবো, তারপর ছবি বিক্রি করে সেই অর্থ আন্দোলনকারী কৃষকদের হাতে সেই অর্থ তুলে দেব। বললাম, কিন্তু এখন তো দিল্লিতে ঠান্ডা পড়েছে, আপনারও বয়স হয়েছে, বাড়িতে কথা বলেছেন? বিরক্ত হয়ে বললেন— সেসব তোমায় ভাবতে হবে না, তুমি যাবে কি না বলো। আমার অলসতা ও অন্য নানান পিছুটানের কারণে আমি হ্যাঁ বলতে পারিনি এবং শেষ পর্যন্ত রবীনদারও দিল্লি যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এই হলেন রবীনদা, রবীন দত্ত।


জন্ম ১৯৪২ সালে অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। বিপ্লবীদের গা ঢাকা দেওয়ার জায়গা ছিল ওঁদের বাড়ি। ছোট থেকেই বাড়িতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আনাগোনা দেখেছেন, পাশাপা‍‌শি সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রেও ওঁদের বাড়ি ছিল পীঠস্থান। মা হেমলতা দেবীর গান, ছবি আঁকা, নাটক ও শিল্পের অন্যান্য বিভিন্ন শাখায় ছিল অবাধ বিচরণ। চারণকবি মুকুন্দ দাস ছিলেন সম্পর্কে মায়ের কাকা, সেই সুবাদে ঘন ঘন যাতায়াত। এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় হওয়ার কারণে রবীন দত্তর মনেও তার প্রভাব পড়ে। দেশভাগের পর উত্তর চব্বিশ পরগনার ব্যারাকপুরে পরিবার আশ্রয় নেয়। এখানে দুই দাদা ক্রমশ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িয়ে পড়েন। রবীন দত্ত কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হন। শিল্পশিক্ষার পাশাপাশি চেতনার অন্তঃস্থলে থাকা বামপন্থী ভাবধারা ওঁকে কমিউনিস্ট পার্টির কাছাকাছি নিয়ে আসে।

কলেজে থাকতেই ভিয়েতনামের লড়াইয়ের সমর্থনে পথে নামেন ও পোস্টার লেখায় হাত পাকান। কলেজ থেকে বেরিয়ে সরকারি বিদ্যালয়ে অঙ্কন শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। কিন্তু কলকাতা থেকে দূরে থাকতে মন সায় দিচ্ছিল না, ফলে সেই চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন ও বিজ্ঞাপন সংস্থায় যোগ দেন। পরবর্তী চার দশকে কলকাতার বিজ্ঞাপন জগতের সর্বোচ্চ স্তরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
পেশাদারি জীবনের পাশাপা‍‌শি আদর্শে শান দেওয়ার কাজও চলতে থাকে। ছয়ের দশকের শেষের দিকে বিজন চৌধুরির নেতৃ‍‌ত্বে গড়ে ওঠে পেন্টার্স ফ্রন্ট, রবীন দত্ত এর সাথে যুক্ত হন। সঙ্গে পান নির্মাল্য নাগ, সজল রায়, অজিতবিক্রম দত্ত, পরিমল দত্ত রায়, গোপাল দাস, বিশ্বনাথ দাস, অমর দে প্রমুখ শিল্পীকে, শুরু হয় বিকল্পধারার চিত্রচর্চা। যে ক্যানভাসে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ছবি ফুটে উঠবে, তার রক্ত-ঘাম-লড়াই-সফলতা-ব্যর্থতা মূল বিষয় হয়ে উঠবে। আদর্শ হিসাবে সামনে ছিল চীন, রাশিয়া, মেক্সিকো, চিলির সমাজতান্ত্রিক শিল্পকলার নমুনা।



উনিশশো বাহাত্তরের নির্বাচন পর্যন্ত পেন্টার্স ফ্রন্ট তার শিল্পের সম্ভার নিয়ে বামপন্থী গণআন্দোলনের সহযোগী শক্তি হিসাবে কাজ করতে থাকে, সেই দলে রবীন দত্তও শামিল হন। বাহাত্তরের নির্বাচনের পর গোটা রাজ্যে আধা ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হয়, হাজার হাজার বামপন্থী কর্মী এলাকা ছাড়া হন, খুন হন প্রায় বারশো কর্মী। এই সন্ত্রাসের আওতা থেকে পেন্টার্স ফ্রন্টও বাদ যায় না, তখন গড়ে ওঠে নতুন এক সংগঠন লোকচিত্রকলা। রবীন দত্ত এখানে যুক্ত হলেন। ১৯৮০ সালের লোসভা নির্বাচনের আগে পেন্টার্স ফ্রন্ট একটা পুস্তিকা প্রকাশ করে, নাম ‘জয় করে আনো লাল দিন।’ এর প্রচ্ছদ করেন রবীন দত্ত। সেই পুস্তিকা এবং তার প্রচ্ছদ প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয় এবং গোটা রাজ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ তৈরি হলে রবীন দত্ত সেখানেও যুক্ত হন এবং সংগঠনের লোগোর ডিজাইন করেন। 

পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ ফিল্ম সেন্সর বোর্ড ও রাজ্য চারুকলা পর্ষদের সদস্য মনোনীত হন। রাজ্য চারুকলা পর্ষদের সদস্য হিসাবে জেলায় জেলায় ছেলেমেয়েদের কাছে শিল্পশিক্ষার পাঠ পৌঁছে দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কা‍‌জে রবীন দত্ত নিয়মিত হাজির থেকেছেন। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শিল্পশিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিয়ে, পথ দেখিয়ে কলকাতার আর্ট কলেজের দোরে পৌঁছে দেওয়ার কাজে রবীনদার ছিল অন্তঃহীন উৎসাহ। ১৯৭৫ সাল থেকে রবীন দত্ত নিয়মিত প্রদর্শনী করতে থাকেন। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রাহক তাঁর ছবি সংগ্রহ করেছেন। এমনকি তাঁর আঁকা ফিদেল কাস্ত্রোর প্রতিকৃতি কমরেড হরকিষাণ সিং সুরজিৎ নিজের উদ্যোগে ফিদেল কাস্ত্রোর কাছে পৌঁছে দেন। তাঁর দীর্ঘ শিল্পীজীবনে সাম্রাজ্যবাদ- স্বৈরাচার- সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন।

সাম্প্রতিক সময়েও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি তাঁর ছবির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অপরিকল্পিত লকডাউন ও তার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্দশা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। এই বিষয় নিয়ে একের পর এক ছবি আঁকতে থাকেন। পাশাপা‍‌শি ওঁর বাসস্থান অঞ্চলের রেড ভলান্টিয়ার্সদের কর্মকাণ্ডে প্রবল উৎসাহিত হয়ে পড়েন এবং ওঁর একাধিক ছবির বিষয় হয়ে দাঁড়ায় রেড ভলান্টিয়ার।
রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি প্রবলভাবে চিন্তা করতেন এবং বলতেন— এই অন্ধকার বেশিদিন থাকে না, থাকতে পারে না! এ আঁধার কাটবেই। ২০১১-র পর থেকে অত্যাচার ‍‌এবং নারকীয়তার প্রতিটি ঘটনায় তিনি ছবির মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, সেটা ছাত্র সুদীপ্ত গুপ্তর হত্যা হোক বা কামদুনির দলবদ্ধ ধর্ষণকাণ্ড অথবা সাম্প্রতিক সময়ে আনিস খানের হত্যা।

রবীন দত্ত একজন অত্যন্ত ব্যতিক্রমী শিল্পী ছিলেন। রাজনৈতিক সামাজিক ঘটনায় আলোড়িত হয়ে তিনি ছবি এঁকে গেছেন এবং সেগুলো নিছক পোস্টার না হয়ে বিশুদ্ধ ও উন্নত শিল্পকলার রূপ নিয়েছে। রবীন দত্ত সময়ের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ছবি এঁকেছেন আর এখানেই তিনি তাঁর সমসাময়িকদের থেকে স্বতন্ত্র ও সম্ভ্রান্ত। তিনি একই সঙ্গে শিল্প ও ইতিহাস রচনা করেছেন। এই কঠিন সময়ে ওঁর চলে যাওয়া রাজ্যের বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কাছে এক বড় ক্ষতি।

Comments :0

Login to leave a comment