পুলিশ চাইলে আর জি করের তরুণী চিকিৎসক খুন ও ধর্ষণের কিনারা করতে পারে সহজেই এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই। কিন্তু গুরুতর প্রশ্ন হলো পুলিশ সেটা চাইছে কি না। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন রাজ্য সরকার এবং তার মাথার ওপর বসে আছেন যিনি তিনি চাইছেন কি না। অতীতে এধরনের অনেক ঘটনায় পুলিশ ও সরকারের ভূমিকা মাথায় রাখলে সন্দেহ থেকেই যায়। প্রশ্ন উঠে যায় প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে তদন্তের গতি প্রকৃতি কি অবাধ গতিতে স্বাভাবিক পথ ধরে এগচ্ছে? নাকি সর্বোচ্চ স্তর থেকে আগে থেকেই টেনে দেওয়া সিদ্ধান্তকে তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ করার মরিয়া প্রয়াস চলছে গোপনে ও সন্তর্পণে। ঘটনার পর চার-পাঁচদিন কেটে গেলেও তদন্তের অগ্রগতি দেখে মনে হবার উপায় নেই পুলিশ অজানা তথ্য সংগ্রহ করছে নাকি নিজেদের মতো করে ঘুঁটি সাজিয়ে কল্পিত আখ্যান রচনা করছে। একেবারে গোড়া থেকেই পুলিশ যে লুকোচুরি খেলা শুরু করেছিল এখনও তা অব্যাহত। শুরুতেই প্রথম বিভ্রান্তি বড়িয়েছিল আত্মহত্যা বলে প্রচার করে। সত্য যাতে বাবা-মা চাক্ষুষ করতে না পারে তাই হাসপাতালে তাদের দু’ঘণ্টা বসিয়ে তবে দেখতে দিয়েছে যদিও বেশি কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। মৃতদেহের সঙ্গে বাবা-মাকে যেতে দেয়নি। দেহ সোদপুরের বাড়ি পৌঁছে দেবার এক ঘণ্টা পর বাবা-মাকে বাড়ি যাবার অনুমতি দিয়েছে। তার আগে গোটা বাড়ি ঘিরে ফেলা হয় যাতে বাইরের কেউ ঢুকতে না পারে। একইভাবে তড়িঘড়ি শ্মশানে নিয়ে তড়িঘড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে পুলিশের তৎপরতায়। অর্থাৎ কোনোভাবেই মৃতদেহের উপর কারও যাতে বিশেষ নজর দেবার সুযোগ না থাকে তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পুলিশ যা যা বলবে সেটাই মেনে নিতে হবে, পরখ করার কোনও সুযোগ থাকবে না।
ঘটনার চারদিনের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে একজনই। চারদিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রী ধর্ষিতার বাড়ি যান এবং ঘোষণা করেন মোট দশদিনে তদন্ত শেষ না হলে সিবিআই-কে দেওয়া হবে। আর এই দশদিন পুলিশের কাছে বিরাট সময় অনেক কিছু ধামাচাপা দিয়ে একটা একটা রিপোর্ট সাজিয়ে ফেলার। আরজি করের এই ঘটনা একটি নিছক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা নয়। কলকাতার একটি নামী মেডিক্যা।ল কলেজ হাসপাতালে একজন কর্তব্যরত ডাক্তার ধর্ষণের পর খুন হয়েছে। একটা সরকারি হাসপাতালে কতটা অব্যবস্থা, চূড়ান্ত ব্যর্থ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলে এমনটা ঘটতে পারে এই ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গেছে। একজন ডাক্তার টানা ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করেন পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই বলে। হাসপাতালে পুলিশ ও বেসরকারি নিরাপত্তাবাহিনী থাকলেও তারা চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অপদার্থ। সিসিটিভি সব জায়গায় আছে কিনা, থাকলে কাজ করে কিনা যাদের দেখার দায়িত্ব তারাও অপদার্থ। বিভাগীয় প্রধানরাও অপদার্থ। আর গোটা হাসপাতালের সামগ্রিক পরিকাঠামো ও পরিচালন ব্যবস্থা যাদের কড়া নজরদারিতে থাকার কথা সেই অধ্যক্ষ-সুপাররা সবচেয়ে অপদার্থ। এটা শুধু আর জি করে নয় রাজ্যের প্রতিটি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই নৈরাজ্য চলছে বছরের পর বছর ধরে।
মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে রাজ্যের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে পুরোপুরি শাসক দলের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়েছে। বিভিন্ন পদাধিকারীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা মাপা হয় তিনি কতটা দলের নেতাদের অনুগত ও বিশ্বস্ত। আর তৃণমূল মানেই দালালি, তোলাবাজি, দু’নম্বরি পথে টাকা কামানো। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষে এই সবের জন্য সুব্যবস্থা করা এবং এদের জন্য দ্বার অবারিত রাখা। সর্বত্র তাই হচ্ছে। দলীয় দালাল ও মাতব্বরদের খুশি করতে পারলে অনেক সুযোগ মিলবে। ধৃত ধর্ষক সিভিক পুলিশের গুন্ডা, মাতব্বর, দুষ্কৃতি, সমাজবিরোধীর সারাদিন-রাত হাসপাতালে ঘুরে বেড়ায়। এদের অঙ্গুলি হেলনেই চলে হাসপাতাল। এদের সৌজন্যে হাসপাতালে মদ-গাঁজারও অভাব নেই। এরাই বসায় ফুর্তির আসর।
তাই এই খুন-ধর্ষণের অভিযুক্তকে ধরা বা সাজা শেষ কথা নয়। আসল কথা এই অরাজকতা ও নৈরাজ্য থেকে হাসপাতাল তথা গোটা চিকিৎসা ক্ষেত্রের মুক্তি। কিন্তু সেটা তো এই সরকারের অধীনে সম্ভব নয়। তাই লড়াইকে দীর্ঘায়িত করে জমনা বদলের দিকে চালিত করতে হবে।
RG KAR
লড়াই অনেক বড় ও সুদূরপ্রসারী
×
Comments :0