Turkey rescue work

মৃত্যু ১১ হাজার ছাড়িয়ে, হু’র হিসাবে ২০ হাজার

আন্তর্জাতিক

সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলছে। সময় যত এগচ্ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। তুরস্ক-সিরিয়া মিলিয়ে বুধবার রাত পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, মৃত্যু হয়েছে ১১ হাজার ২০০ জনের। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু’র হিসাবে, মৃত্যু ২০ হাজার পেরিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্ততপক্ষে ২৩ লক্ষ। 
সিরিয়া হোক বা তুরস্ক, পরিজনদের জীবিত খোঁজ পাওয়ার আশা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে কোনোরকমে বেঁচে যাওয়া দুর্গতদের। সন্তানদের খোঁজ পাচ্ছেন না মা-বাবা। বহু শিশু নিখোঁজ। ঠান্ডায় কাঁপছেন প্রত্যেকে। আশ্রয় শিবিরের অভাব, খাবার, জলের অপ্রতুলতা, পর্যাপ্ত চিকিৎসাও পাচ্ছেন না জখমরা। ক্রমশ ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন অসহায় মানুষজন। মারাত্মক ঠান্ডা, বরফপাতের মধ্যেও রাতে খোলা আকাশের নিচে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। উদ্ধারকাজে ঢিলেমির জন্য ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে প্রবল ঠান্ডায়ও প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। আবার যাঁরা ওই ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছেন, কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাঁই ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে, তাঁরা ঠান্ডার সঙ্গে যুঝতে না পেরে প্রাণ হারাচ্ছেন। 


এদিন রাত পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, ৮ হাজার ৫৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে তুরস্কে এবং সিরিয়ায় মৃত ২৬৬২ জন। ‘হোয়াইট হেলমেট’ নামে পরিচিত, সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের দখলে থাকা এলাকার উদ্ধারকারীদের হিসাব অনুযায়ী, দেশের সরকার নিয়ন্ত্রিত অংশে ১২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে, জখম দু’হাজারেরও বেশি। অন্যদিকে বিদ্রোহীদের দখলে থাকা অংশে মৃত্যু হয়েছে ১২৮০ জনের। ২৬০০’রও বেশি জখম হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মহল থেকে কোনোরকম সাহায্য পায়নি বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। সিরিয়া সরকারের তরফে এদিন সাহায্যের আবেদন করা হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে। 
তুরস্কের মালাতিয়া শহরে মাঠের মধ্যে পরপর লাইন দিয়ে রাখা রয়েছে দেহ। মোড়া রয়েছে কম্বলে। উদ্ধারকারীদের কয়েকজন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন, কখন শববাহী যান আসবে। উদ্ধারকাজে হাত লাগানো পিকালের কথায়, ‘‘আজকের দিনটা মালাতিয়ার জন্য আরও খারাপ। কোনও প্রাণের আশাই নেই। কয়েকজন তো বহুতলের নিচে চাপা পড়েও বেঁচেছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড ঠান্ডায় প্রাণ হারিয়েছেন। আমাদের হাত জমে যাচ্ছে। হাত দিয়ে কাজ করা যাচ্ছে না। অনেক অনেক যন্ত্রপাতি দরকার।’’ মালাতিয়ার মতোই কোথাও যন্ত্রের অভাব তো কোথাও লোকবলের। বহু জায়গায় ভেঙে পড়েছে রাস্তা, প্রবল তুষারপাতে কিছু রাস্তা বন্ধ। উদ্ধারকারীরা পৌঁছাতেও পারছেন না। সব মিলে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়ে রয়েছে। এরই মধ্যে ভূমিকম্পের উৎসস্থল সংলগ্ন এলাকা পরিদর্শনে যান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তায়েপ এরদোগান। যে দশটি প্রদেশ সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে আগামী তিন মাস জরুরি অবস্থা জারি করে বিরোধীদের সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। কারণ, তুরস্কে নির্বাচনেরও বেশি দেরি নেই। বিরোধীদের একজন এদিন এরদোগানের বিরুদ্ধে আঙুল তুলে বলেন, ‘‘প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় গত ২০ বছর ধরে কোনও ব্যবস্থাই করে উঠতে পারেননি উনি।’’ এদিন থেকে টুইটার ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে তুরস্কে।


সোমবার ভোরে শক্তিশালী কম্পনের পর দুপুরে, বিকালে এবং মঙ্গলবারও ভূকম্প হয়েছে। দুশো’র বেশি অনুকম্প অনুভূত হয়েছে। দীর্ঘ কয়েকঘণ্টা ধ্বংসাবশেষে চাপা পড়ে থাকার পর তুরস্কের খারামানমারাসে উদ্ধার করা হয়েছে তিন বছরের আরিফকে। এখানেই ভূমিকম্পের উৎসস্থল, রিখটার স্কেলে যার তীব্রতা ছিল ৭.৮। ওই শিশুর শরীরের নিচের অংশ ইটের স্তূপে আটকে যায়। চাঙরের মাঝখান দিয়ে বেরিয়েছিলে উপরিভাগ। ঠান্ডার কামড় থেকে বাঁচাতে উদ্ধারকারীরা তাঁকে কম্বল জড়িয়ে রাখেন। পাশেই আরেকটি ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা হয় তার বাবাকেও। এর কয়েকঘণ্টা পর আদিয়ামানে উদ্ধার হয় দশ বছরের বেতুল ইদিস। আরিফ বা বেতুলের উদাহরণ যদিও গুটিকতক। বহু শিশুর কোনও খোঁজ নেই এখনও। মৃত্যু আরও কত বাড়তে পারে তারও কোনও হিসাব মিলছে না। বিভিন্ন দেশের উদ্ধারকারী দল পৌঁছালেও সাড়ে তিনশো কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ভগ্নাবশেষের সর্বত্র তাঁরা যেতে পারছেন না। তুরস্ক-সিরিয়া, দু’দেশেরই সমস্ত উদ্ধারকারী সংস্থা বারবারই জানাচ্ছে, সময় যত এগচ্ছে, ধ্বংসাবশেষ থেকে একের পর এক দেহ উদ্ধার হচ্ছে। ফলে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তুরস্কের ইসকেনদেরান বন্দরে ভূমিকম্পের জেরে যে আগুন লাগে, তা মঙ্গলবার নেভানো সম্ভব হলেও এদিন ফের আগুন জ্বলে উঠেছে। ফলে বন্দরের কাজকর্ম এখনও স্বাভাবিক হয়নি। 
আলেপ্পো, লাতাকিয়া, তারতোস, হামা সহ সিরিয়ার বেশ কিছু প্রদেশ মিলিয়ে আড়াইশো’রও বেশি স্কুল মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২৬টি স্কুলে আশ্রয় শিবির তৈরি করা হয়েছে। উদ্ধারকারীদের না পেয়ে পরিজনরা নিজেরাই কংক্রিটের স্তূপ সরিয়ে পরিজনদের খোঁজ শুরু করেন অনেক জায়গায়। তেমনই একজন, আলি বাত্তাল। ‘‘আমার গোটা পরিবারই ওই স্তূপের তলায়। আমি ওদের কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার ছেলেরা, আমার মেয়ে-জামাই... তাই নিজেই নেমে পড়ি উদ্ধার করতে। কেউ আসেনি ওদের বাঁচাতে’’, কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন তিনি। আলি বাত্তালের ছেলে-মেয়েদের বাঁচানো গিয়েছে কি না জানা যায়নি। আবার হয়তো আরও অনেকে বাঁচতে চেয়ে আর্তনাদ করতে করতেই নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছেন চিরতরে।

 

Comments :0

Login to leave a comment