গল্প
দিনকাল
নন্দিনী সরকার
জিতু যখন স্কুলে যাবার আগে বাড়ির পাশের বড়ো পুকুরে চান করতে নেমেছে, একটু হাত পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটতে শুরু করেছে সবে , পাড় থেকে মা-র ডাক ভেসে এল "এই বাবু, জল থেকে তাড়াতাড়ি উঠে আয়, স্কুলে দেরি হয়ে যাবে তো। খাবার হয়ে গেছে। ভাই কিন্তু তৈরি হয়ে বসে আছে তোর জন্য ।"
ব্যস শুরু হয়ে গেল। যতক্ষণ না জিতু জল থেকে উঠে স্কুলের জামা পরে খেতে বসবে , ততক্ষণ মা-র ফাটা রেকর্ড বাজতেই থাকবে।
গামছাটা ঠিক করে পরে পুকুর থেকে ওঠবার সময় জিতু পাশের পাড়ে দেখে গলির কাজলদা দিব্যি পুকুরে ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে ব্যাং লাফ খেলছে। কোনো কিছুতেই ওর নিষেধ নেই। কি ফুর্তির জীবন!পাড়ায় বখাটে বলে পরিচিত। নিজের মনেই জিতু একবার নিজেকে ভেংচি কেটে দেয়।
স্কুল থেকে পড়া সেরে ফেরার পথে ফুচকার দোকানে দেখে সেই কাজলদা বন্ধুদের সাথে বাজি রেখে ফুচকা খাচ্ছে। আর জিতু? বাড়ি ফিরে যদি ভাত না -খায় তো মা চ্যাঁচিয়ে মাত করবে। ভয়েতে ইচ্ছে করলেও একদিন ফুচকা খেতে পারে না।
মাঠে ফুটবল খেলে সন্ধের সময় বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখে রাস্তার মোড়ে বন্ধুদের নিয়ে কাজলদা আড্ডা মারছে। তার সাথে ওদের হাতে হাতে সিগারেট, বিড়ি আর মুখে নোংড়া ইয়ার্কির তুবড়ি। জিতু এগুলো যদিও পছন্দ করে না, কিন্তু এখন যেন মনটা হিংসেতে ভরে ওঠে। কি আর করা যাবে? বাবা ঘরে ঢোকার আগেই ওকে হাত- মুখ ধুয়ে পড়তে বসতে হবে__তাই তড়িঘড়ি পা চালায় ঘরের দিকে।
এইভাবে দিন কাটতে থাকা জিতু এবার জানতে পারে কাজলদা নাকি পড়াশুনোই ছেড়ে দিয়েছে। আর দিব্যি ওর কাকাদের সাথে আনাজ ব্যবসায় নেমেছে। আর জিতুকে নাকানিচোবানি খেতে খেতে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাস করে ফার্মাসিস্ট -এ ডিপ্লোমা করতে হয়েছে। এর মধ্যেই ধীরে ধীরে দেখেছে পাড়ায় কাজলদার বাড়বাড়ন্ত। কাজলদা আনাজের ব্যাবসা ছেড়ে লেগেছে ইট -বালি সাপ্লাইয়ের কাজে।
তার কাজ বেড়েছে। পরে সাপ্লাই ছেড়ে একেবারে প্রোমোটিং এর ব্যবসায় হাত পাকাচ্ছে। কাজলদা এখন পাড়ার নেতা আর চাঁদা দেবার মাথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুরু করেছে বিরাট কার্তিক পুজো। পাড়ার সকলে প্রতিবছর কার্তিক পুজোর ঢালাও প্রসাদ পায় আর ধন্য ধন্য করে। কাজলদার কথাবার্তা, চালচলন বদলে গেছে একেবারে। ওদিকে জিতু ওষুধ কোম্পানিতে একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টটেটিভ হয়ে কাজ করছে। সকালে নাকে -মুখে গুঁজে বেরিয়ে পরে দুচাকা নিয়ে আর সারাদিন ডাক্তারদের পেছন পেছন ঘোরে। হ্যাঁ, মাইনে পায় ভালোই , তবে খাটনিতে পোষায় না। ওদিকে কাজলদাকে দেখে জিতু নিজের মাথা ঠিক রাখতে পারে না।পাড়ায় ফ্ল্যাট কেনা ,জমি রেজিস্ট্রি করা__ সবেতেই কাজলদার সই এখন অতি মূল্যবান সম্পদ। পাড়ায় ফ্ল্যাট সংক্রান্ত সব ঝামেলা সালটে দেবার জন্য কোম্পানিতে ওর মাইনে নাকি মাসে প্রায় দেড় লাখ।
এলাকায় গণ্যমান্য ব্যক্তিরূপে কাজলের কিছুটা খ্যাতিও বেড়েছে।
জিতুর চারবছরের ছোটো ছেলেটা যখন পড়তে বসে বায়না করে আর মা-এর কাছ থেকে মার খায় , তখন জিতুর খুব খুব রাগ হয়। নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পরে।
সেদিন বলেও ফেলে পাড়ার এক শিক্ষিত দাদাকে ওর ক্ষোভের কথা।
দাদা খানিক তাকায় জিতুর দিকে। আস্তে আস্তে শেষে বলে " তুই ভুল ভাবছিস রে জিতু, তোর কাজের পরিধি, খাটনি বেশি হলেও রাত্রের ঘুমটা শান্তিতে হয় নিজের বিছানায়, যেটা কাজলদের মতো মানুষের হয় না। আর সাধারণ মানুষও ওর সামনে হেঁ হেঁ করে স্তাবকতা দেখালেও পেছনে সত্যিটাই বলে। তাই আপশোশ করিস না। লেখাপড়ার দাম, শিক্ষার দাম সর্বজনীন।"
জিতু রাত্রে ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মনে মনে বলে- "তুই মানুষ হোস। তুই ভালো মানুষ হোস।" জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে আদর বুলিয়ে দিয়ে যায় ছেলের চোখে মুখে। চিরকালীন
পিতারূপে জিতুর মুখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে।
Comments :0