STORY — TUSAR BOSE / SHARAD NATUNPATA

গল্প — নোনা মাটির কারিগর / শারদ নতুনপাতা

ছোটদের বিভাগ

STORY   TUSAR BOSE  SHARAD NATUNPATA

শারদ নতুনপাতা

বড়গল্প
নোনা মাটির কারিগর 
তুষার বসু

  -'দাদু, পঞ্চুমির আগে শেষ করতে পারবে তো?' আশঙ্কায় গলাটা কেঁপে উঠল তপনের। মহিষাসুরের গলে যাওয়া মুখটার ওপর বাঁশের চাঁচ দিয়ে মাটি লাগিয়ে সেটা মেরামত করার চেষ্টা করছিল বিজয় পাল। এই আশঙ্কাটা যে তাকেও তাড়া করছে সেটা বুঝতে না দিয়ে যেন নিজেকেই ভরসা যোগাতে বিজয় বললো -' তা আর পারবোনা? তুই আর আমি দুজনে পড়ে খাটলে নিশ্চয়ই হয়ে যাবে। ' বয়সটা যদি দশ বছর কম হতো বিজয় পালের তাহলে নিশ্চিত হতে পারত, কিন্তু আশি ছুঁই ছুঁই বয়সটা তাকে বড্ড দুর্বল করে দিয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা দুর্গার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন শক্তি প্রার্থনা করলো সে, তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের কাজে।
   আগে বিজয় পালের বাড়িতে দশ-বারোটা দুর্গামূর্তি তৈরি হতো। বিজয় আর বিজয়ের ছেলে জগন্নাথ দু'জন মিলে অনায়াসে মূর্তিগুলো প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে পাঠিয়ে দিতে পারত পঞ্চমীর আগেই।কিন্তু কয়েকবছর আগে হঠাৎই কি এক ভয়ংকর অসুখে তাদের ছেড়ে চলে গেলো অমন তরতাজা ছেলেটা। আর বিজয়েরও দু:খের দিন শুরু হলো। আজকাল বেশি প্রতিমা গড়তেও পারেনা, আর থিমের পুজোর চল শহরের গন্ডি ছাড়িয়ে গ্রামে এসে পৌঁছেছে। সে-সব মূর্তি বিজয় গড়তেও পারেনা। কমতে কমতে কেবলমাত্র মুখুজ্জেবাড়ির প্রতিমাটিতেই এসে অঠেকেছে।  বাবার আমল থেকে ওরাই মুখুজ্জেবাড়ির ঠাকুর গড়ে আসছে তাই। তাও আর কদিন পারবে তার ঠিক নেই। মুখুজ্জেমশাই ঠাকুর বায়না দিতে এসে অবশ্য বলে গিয়েছেন -'নাতিকে সব শিখিয়ে পড়িয়ে তৈরি করে নাও বিজয়, এরপর থেকে তো ওকেই গড়তে হবে, নাকি?' বিজয় সলজ্জভাবে বলেছিল -'তা আপনাদের আশীর্বাদে নাতির আমার শেখার আগ্রহ খুব। ইস্কুলের সময় আর পড়ার সময়টুকু ছাড়া আমার সঙ্গে সঙ্গেই লেগে থাকে। খড় বাঁধা আর চক্ষুদান ছাড়া প্রায় সবই শিখে ফেলেছে। দু'এক বছরেই মধ্যে তাও শিখে নেবে।'  -'বা: বা: খুব ভালো। তা তোমার নাম কি খোকা?' জানতে চাইলেন মুখুজ্জেমশাই। 
-'আমার নাম তপন কুমার পাল।' বলেছিল তপন।
হঠাৎ বিজয় বলেছিল -' একটা আবেদন ছিল মুখুজ্জেমশাই,  বলবো?' 
-'হ্যাঁ হ্যাঁ,  বলো।'


- ' বলছিলুম কি, প্রতিবছর তো আমাকে আপনি কাপড় দেন, এ বছর যদি তার বদলে আমার এই নাতিটাকে একটা জামাপ্যান্ট দেন তো----' আর বলতে পারেনা বিজয়, গলাটা তার বুজে আসে। 
-'এই কথা! আচ্ছা তা দেওয়া যাবেখন। তোমার নাতির জামাপ্যান্টের মাপটা একটা কাগজে লিখে দিও। মহালয়ার আগে তোমাকে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেবো ঠাকুরের সাজ কেনার জন্য। আজ আমি উঠি।' চলে যান মুখুজ্জেমশাই। 
      কদিন ধরে একটানা বৃষ্টিতে পথঘাট থই থই। মূর্তিটা পলিথিনে ঢেকে উঠোনে বসানো ছিল, দোরে তোলা হয়নি। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে চাষিরা বৃষ্টির জন্য হাহুতাশ করেছে, কৃপণ আকাশের দয়া হয়নি। সবাই ভেবেছিলো এভাবেই এবারে কাটবে। কিন্তু আশ্বিনের মাঝামাঝি এই প্রবল বর্ষণে নদীর কূল ছাপিয়ে জল এসে ঢুকেছে গ্রামের ভিতরে। ঠাকুরটা দোরের ওপর তোলার জন্য তপন লোকজনকে ডাকতে গ্রামের এমাথা-ওমাথা ছুটে বেড়িয়েছে। কিন্তু সকলেই যে যার নিজের ঘরদোর, গরুবাছুর বাঁচাতে ব্যস্ত, কে আসবে? চোখ ফেটে জল এসেছে সেদিন তপনের।  কাউকে পায়নি। পরের দিন দু'একজনকে ডেকে যখন দোরের ওপর ঠাকুরটা তোলা হলো তখন নিচের অংশে আর মাটি ছিলোনা। পলিথিনের পাতলা চাদরটা ছিঁড়ে ঠাকুরের ওপরের অংশেও অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেছে। সেই থেকে দাদু-নাতি মিলে দিনরাত লেগে আছে মূর্তিটা আবার নতুন করে তৈরি করতে।


    মহালয়া এসে গেলো। অনেক পরিশ্রমে তারা মা দুর্গাকে আবার দাঁড় করিয়েছে। এবার শুধু রঙ করলে আর সাজ পরালেই হয়ে যাবে। কিন্তু মুখুজ্জেমশাই যে বলে গিয়েছিলেন মহালয়ার আগেই সাজ কেনার টাকা পাঠিয়ে দেবেন, কই পাঠালেননা তো। বিজয় উতলা হয়ে পড়ে। তবে কি ভুলে গেলেন?  
একবার পায়ে পায়ে গেলে হতো। কিন্তু মুখুজ্জেবাড়ি তো কম দূরে নয়, প্রায় দু'-আড়াই কিলোমিটার রাস্তা। শেষমেশ তপনকেই যেতে হলো।  যাওয়ার আগে 
একটা কাগজে তপনের জামাপ্যান্টের মাপটা লিখে তপনের পকেটে দিয়ে বিজয় বললো -'এটা গিয়ে মুখুজ্জেমশাইয়ের হাতেই দিবি।আর কাউকে দিসনি যেন।'

     দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকের শব্দে বোঝা যাচ্ছে সপ্তমীর আরতি হচ্ছে কোথাও, নাহলে এই পুরনো খড়ের চালের বাড়িটায় পুজোর কোনও ছোঁয়া এসে লাগেনি।আকাশে আধখানা চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় দোরের ওপর রঙ না হওয়া মাটির মূর্তিটাকে একটা অতিকায় মাকড়সার মতো দেখতে লাগছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তপন। দাদু খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে কেমন হতাশভাবে বসে আছে। সেদিন মুখুজ্জেবাড়িতে গিয়ে তপন শোনে মুখুজ্জেমশাই হঠাৎ মারা গেছেন, তাই এবছর পুজো বন্ধ। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর ঠাকুরের দাম পাওয়ার আশা দুটোই হঠাৎ আসা বন্যার জলে ভেসে গেছে। মাত্র কটা দিনে দাদু যেন আরও বুড়ো হয়ে গেছে।  তপন উঠে যায় দাদুর কাছে। বিজয় শূন্যচোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তপন দাদুর পিঠে হাত রাখে, বলে -' দাদু তুমি যে দুটো লক্ষ্মীঠাকুরের বায়না নিয়েছো, গড়বেনা?'


-' আঁ---'যেন কোনও গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠলো বিজয়। 'কি বললি?' 
 -'বলছি, লক্ষ্মীঠাকুরদুটো গড়বেনা?' 
-'হ্যাঁ,  গড়তে তো হবেই। চল।' বলে বিজয় নেমে দাঁড়ালো উঠোনে। 
  খড়-বিচালি শক্ত করে ধরে দড়ির টান দিয়ে বিজয় পাল নতুন করে স্বপ্ন তৈরি করতে শুরু করে। আর তপন বসে পড়ে মাটি তৈরি করতে। চোখের জল আর গা বেয়ে নেমে আসা ঘামে সে মাটি ক্রমশই পাতলা হয়ে যায়। সে ধানের তুঁষ মিশিয়ে শক্ত করতে চায় প্রাণপণে,  তবু্ও ক্রমশই পাতলা হয়ে দু'হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায় মাটি। মাথার ওপর গাছের পাতা থেকে টুপ টুপ করে শিশিরের জল ঝরে পড়ে। শুধু আধখানা একটা চাঁদ যথাসাধ্য তাদের আলোকিত করতে করতে সাক্ষী হয়ে থেকে যায় এক হার না মানা জীবনযুদ্ধের।

Comments :0

Login to leave a comment