Story — SAIKAT KUNDU / MUKTADHARA - 11 DECEMBER

গল্প — লেলিহান শিখা / মুক্তধারা

সাহিত্যের পাতা

Story  SAIKAT KUNDU  MUKTADHARA - 11 DECEMBER

মুক্তধারা

গল্প
লেলিহান শিখা

সৈকত কুন্ডু

ছেলেটার চোখদুটো পাথর হয়ে গেছে।বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে একটানা গোঙানির মতো কান্না। বৃষ্টির সোদা গন্ধটায় কেমন যেন চামড়া পোড়া গন্ধ।
টানা সাতদিন ধোরে হুমকি। রক্তাক্ত চোখগুলোও গা সওয়া হয়ে গেছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকা মানুষগুলো বলেছিল এবার শেষ দেখে ছাড়বে।
ছেলেটার দুটো চোখ পাথরের মতো স্তব্ধ। কেবল ওর কানে বাজছে-বাপ ভাত দুটো খেয়ে যা। ছেলেটা তড়িঘড়িতে বলেছিল-ক্যাটারিংয়ের ওখানে খেয়ে নেব।সময় নেই। তোমরা সাবধানে থেকো।বাপ তবু পিছনে এসেছিল খানিকটা। ছেলের  
সাইকেল যতক্ষণ দেখা যায় সে তাকিয়ে ছিল। দিনকাল ভালো নয়। ভোটের বাজার। এমনিতেই এদিককার হাওয়ায় বারুদের গন্ধ।
বৃষ্টিটা বেশ জোরেই নামলো। সঙ্গে ঝড়। বাতসে সোঁ সোঁ আওয়াজ। ছেলের মা বলল-পতাকা গুলোর মাড় ভাঙেনি গো। নতুন লাল থানের। কালকেই লাগানো।
হ্যাঁ গো।বৃষ্টিটা কমতে দেবে তো নাকি?সব ঠিক করে দেবো।জলে ভিজে লাল রংটা পুরো তোমার বিয়ের লাল টুকটুকে বেনারসীর মতো হবে।তার উপর যখন রোদ পড়বে না।আহা।
তোমায় কাব্যিতে ধরলো নাকি আবার-লাজুক ঠোঁটে মুচকি হাসে মা।

চালের উপর বৃষ্টি আঁছড়ে পড়ছে। পাড়াটা নিস্তব্ধ। এ কমাস রাত হোলেই ঘাসফুলের বাবুরা হানা দিচ্ছে। সঙ্গে গামছা বাঁধা উন্নয়ন। কিছুতেই দমাতে পাড়ছেনা গ্রামটাকে।রাত হোলেই ঘরে দরজা আটকে কীসের এক অজানা অচেনা  
হায়নার পায়ের শব্দের জন্য অপেক্ষা। ক্যাটারিংয়ের কাজে চাপ খুব। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে ছেলের। কোনওদিন এমন হয়না। ছোটবেলায় বাবা মার হাত ধোরে তার লাল পার্টির মিছিলে যাওয়া  
শুরু।কলেজেও সে জোর করে মারের মুখেও নমিনেশান তুলেছে। বাপ মার হাসি মুখ বলেছে জান দিবি তাও মান দিবিনা। কদিন আগে ভাড়াটে গুণ্ডারা তাদের বাড়ি এসে শাসিয়ে গেছে। কালও এসেছিল। তাও প্রতদিন গ্রামসভা চলছে।  
লাল পতাকা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে গ্রামটাকে।
কতো ছিঁড়বি ছেঁড়। আজও সে কাজে আসতে চায়নি। বাবাই জোর করো পাঠিয়েছে। আইসক্রিমের বারটাকে সন্তর্পনে কাটতে কাটতে সে এসবই ভাবছিল। রাত তখন দশটা। শেষ ব্যাচ। ডিজে  
বক্সটা আচমকা বন্ধ হয়ে গেল। কারা যেন তার নাম ধোরেই চিৎকার করে ডাকছে।বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো।
আকাশটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল মুহুর্তে। কানের মধ্যে ধাতব শব্দ। পৃথিবীটা দুলে উঠল যেন। পোড়া ভিটের সামনে  
দাঁড়িয়ে তার চোখদুটো পাথর হয়ে গেল। কোনও কথাই তার কানে ঢুকছেনা। চোখের সামনে সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা দেওয়া দুটো দেহ।
তোর বাপ মাকে ওরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে।কে যেন বলল। ছেলেটা কেবল ফ্যালফেলিয়ে  
তাকিয়ে রইল। চোখ দিয়ে কান্নাও আসছেনা। আগুন টা যেন তাকেই পুড়িয়ে খাঁক করেছে। ওরা কী পশু?
বাবার বিকেল বেলার তাকিয়ে থাকা আর মার ভাতের কথাটা মনে পড়তেই মাথাটা আবার হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল। ছিটকে পড়ার  
আগেই কে যেন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বাপ মোর আমরা আছি। তুই শহিদের ছেলে। মাথা উঁচু করে থাক।
তার পর আর সে কাঁদেনি। পুড়ো গ্রাম তার পোড়া বাড়ির ভিটেয়। গভীর রাতে পুলিশ এল। ওরা শুধু দেহদুটোকে নিয়ে যেতে  
এসেছে। মুড়ো ঝাঁটা, বটি নিয়ে মেয়ে বউরা দেহ ঘিরে রইল। খবরদার। এ খুনের বিহিত করো। নইলে পথ দেখো। যুবকরা মারমুখী-শালা, খুনির দালাল গুলো এসেছে। মারো শালাদের। না কেউ সরকারি চামচিকেদের কিছু করেনি। কেবল  
বলেছে হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করবে। তেরোতলার ঠান্ডাঘর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে শটশার্কিট তত্ত্ব।
মানুষগুলো ক্ষোভে ফুঁসছে। রাত জাগছে পুরো গ্রামটা। বাচ্চাগুলো আধোঘুমে শিহরে উঠছে।
ছেলেটা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চোখে জল নেই। সে  
কেবল তাকিয়ে আছে তার বাবা মায়ের বিকৃত শরীরদুটোর দিকে। মাথার উপর একটা বরাভয়ের হাতের ছোঁয়া। আর সামলাতে পারলোনা। হাতদুটোকে জড়িয়ে ধোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল ছেলে।হাত দুটোর মানুষটা বুকের উপরে  
টেনে নিল ছেলেটাকে—কান্নাকে গলায় বেঁধে শুধু চিৎকার করে উঠল-কমরেড শহিদদেরকে মৃত্যু ছুঁতে পারেনা। তুই আমার ছেলে। আমাদের ছেলে। ওদের চোখে চোখ রেখে গর্জে ওঠ-চামড়া পুড়তে পারে। আদর্শ নয়।
সকালে পুলিশ দেহ  
নিয়ে গেল। পোড়া ভিটেয় বাবা মায়ের স্মৃতির উপর ঠায়ে বসে রইল ওরা তিরিশ জন।যতক্ষণ না দেহ সৎকার হোচ্ছে ওরা দাঁতে কুটো কাঁটবেনা।
শহরের লাশকাটা ঘরে ছেলেটার বাবা মায়ের পোড়া শরীরটাকে চিড়বে সরকারি ডাক্তার।  
হাসপাতাল ঘিরে বসে আছে হাজার মানুষ। গ্রামের দুঃখে কাঁদছে শহর। এ কান্নায় শুধুই বারুদ।

খবর ভাসছে সরকার ভয় পাচ্ছে পোড়া শরীরদুটোকে। ওগুলো নাকি বড় বেশি জীবন্ত। ওগুলো নাকি
এক একটা হাইড্রোজেন বোম। তাই লাশ পাচারে পিএইচ ডি পুলিশ চুরি করবে দেহ দুটোকে।
ছেলে মাথা তুলে দেখল তার বাবা মা আজ  
এতো লোকের বাব মা হয়ে গেছে। হাতে হাতে জ্বলছে মশাল। গলায় আওয়াজ-না। দেহ ফেরৎ দাও।
ঘুমহীন চোখ গুলো জেগে আছে।পিল পিল করে লোক বাড়ছে জোয়ারের জলের মতো। যদি না দেয় ছিনিয়ে নেওয়া হবে। ছেলেটা অবাক  
হয়। শিরদাঁড়াটা খাঁড়া করে আদলতে বিচারকের কাছে দাবী জানায়। বলে ওঠে, ধর্মাবতার এ কোন রাজ্য যখানে সরকার খুন হওয়া দুটো পচ গলা দেহকে পাচার করতে চায়। ফিরিয়ে দিতে পারবেন না ওদের। দেহ দুটোকে তে পারেন।  
ওর গলার শব্দে কেঁপে উঠল ঘুন ধরা দেওয়ালের প্রতিটা ইট।
অবশেষে। সাদা প্লাস্টিকে আপাদমস্তক জড়ানো দুটো দেহ। ছেলেটা উঠে দাঁড়ায়। পিঠের কলেজ ব্যাগ থেকে বার করে তার মায়ের হাতের তৈরি সিল্কের দুটো লাল পতাকা।  
পরম যত্নে ঢেকে দিল দুটো শরীর। কী আশ্চর্য একেবারে মাপের। এটা বানানোর সময়ে মা হেসে বলেছিল-খোকা যখন মরবো তখন গঙ্গাজল দিতে ভুললে ভুলিস, এটা জড়িয়ে দিতে ভুলিস না। এই পতাকা গরীবের হকের বাপ, হকের।  
বাবাও সায় দিয়েছিল।
চারদিক থেকে আওয়াজ উঠেছে তার বাবা মায়ের নামে। অমর শহিদ তোমাদের ভুলবো না।
ছেলেটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।দুটো অবিনশ্বর আদর্শের দিকে।তার দৃষ্টিতে আর কোন কান্না নেই। কেবল আগুনের  
লেলিহান শিখা দপ করে জ্বলে উঠল।

 

Comments :0

Login to leave a comment