প্রাথমিকে দুর্নীতিতে সিবিআই’র চার্জশিটে পার্থই ‘মাস্টারমাইন্ড’
নিয়োগ দুর্নীতিতে ইডি’র মামলায় পার্থ চ্যাটার্জি সহ ২৯জন এবং অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস সহ ২৫টি সংস্থার বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া চলছে আদালতে। তারই মধ্যে শুক্রবার দুপুরে সিবিআইয়ের তরফে পার্থ চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে নিয়োগ দুর্নীতির মামলাতেই নতুন করে চার্জশিট দায়ের করা হলো।
প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতির মামলাতেই সিবিআই এই চার্জশিট দিয়েছে। দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি ও সিবিআইয়ের তরফে প্রাথমিক ও এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিটি চার্জশিটেই রয়েছে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির নাম।
প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে নতুন করে পার্থ চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে একাধিক তথ্য প্রমাণ হাতে আসার পরে বিশেষ সিবিআই গত ১ অক্টোবর আদালতে পার্থ চ্যাটার্জিকে গ্রেপ্তারের আবেদন জানায়। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করে। পার্থ চ্যাটার্জির পাশাপাশি শাসক তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ প্রোমোটার, পৌরসভা নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত অয়ন শীলকেও প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতে ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ দেখিয়ে গ্রেপ্তার করে সিবিআই।
সেই মামলাতেই ৯০ দিনের আগেই এদিন চার্জশিট দায়ের করল সিবিআই। তাতে পার্থ চ্যাটার্জির পাশাপাশি ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীল, বেহালার বাসিন্দা সন্তু গঙ্গোপাধ্যায়ের নামও রয়েছে। সিবিআই জানিয়েছে প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে সন্তু গঙ্গোপাধ্যায়েরও বড় ভূমিকা রয়েছে তার। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ এবং ‘কালীঘাটের কাকু’র হয়ে টাকা তুলেছেন তিনি। গত কয়েক দিন বেশ কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সন্তুর নাম উঠে এসেছে বলে দাবি সিবিআইয়ের। বেহালার বাসিন্দা। তৃণমূলের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সন্তুর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ‘কালীঘাটের কাকু’, কুন্তল ঘোষ, শান্তনু ব্যানার্জি এবং শিক্ষক ও পৌর নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত অয়ন শীলেরও। সিবিআইয়ের এদিনের চার্জশিটেও পার্থ চ্যাটার্জিকেই দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড বলে দাবি করা হয়েছে।
চলতি মাসেই ইডি’র তরফে আদালতে দায়ের করা পঞ্চম অতিরিক্ত চার্জশিটেও পার্থ চ্যাটার্জির দুর্নীতির একাধিক ছবি সামনে নিয়ে আসা হয়। তাঁর প্রয়াত স্ত্রী বাবলি চ্যাটার্জির নামে ট্রাস্ট করেও কোটি কোটি টাকা সরিয়েছিল পার্থ চ্যাটার্জি। ইডি’র চার্জশিটে দাবি করা হয় নাকতলার এক প্রোমোটারের মাধ্যমে এই কারবার চালাতো পার্থ চ্যাটার্জি, সঙ্গী ছিল তার জামাই কল্যাণময় ভট্টাচার্য। প্রয়াত স্ত্রীর নামে পিংলায় একটি ইংরেজি মাধ্যমের ঝাঁ চকচকে স্কুল গড়া হয়েছে। সেই বাবলি চ্যাটার্জি মেমোরিয়াল ট্রাস্টের ডোনেশনের মাধ্যমে নিয়োগ দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করা হতো। খাতায় কলমে দেখানো হতো লক্ষ লক্ষ টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি এই ট্রাস্টে ডোনেশন হিসাবে জমা দিচ্ছে চেকের মাধ্যমে। আসলে সেই পরিমাণ টাকা খোদ পার্থ চ্যাটার্জিই তাদের দিয়েছে নগদে। সেই টাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চেকের মাধ্যমে পার্থ চ্যাটার্জির স্ত্রীর নামে ঐ ট্রাস্টে অনুদান হিসাবেই জমা করে। কালো টাকা হয়ে যায় সাদা। দিনের পর দিন রীতিমত পেশাদার অপরাধীর মতো এই চক্র চালিয়েছে একদা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চ্যাটার্জি।
রাজ্যে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ দুর্নীতির ভয়াবহ ছবি সামনে এসেছিল ২০২২ সালের ২২জুলাই। সেদিন নাকতলায় পার্থ চ্যাটার্জির বাড়ি থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করে ইডি। তার আগের দিন পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতা মুখার্জির ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় কোটি কোটি নগদ টাকা। খাটের তলা থেকে ড্রয়িং রুম, বেডরুম থেকে এই কাঁড়ি কাঁড়ি নগদ টাকা উদ্ধারের দৃশ্য দেখেছিলেন রাজ্যের মানুষ। মোট উদ্ধার হয়েছিল নগদ ৪৯কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। এছাড়াও প্রায় পাঁচ কোটি টাকার সোনা গয়না, বিপুল সম্পত্তি, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার হয়েছিল, মিলেছিল ভুয়ো কোম্পানির হদিশ। মন্ত্রী থাকাকালীনই টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়া, মেধা তালিকা পরিবর্তন করে দেওয়া, টাকার বিনিময়ে বিএড কলেজে অনুমোদন দেওয়া, বারুইপুর থেকে শান্তিনিকেতন—একাধিক বাগান বাড়ি, স্ত্রী,জামাইয়ের নামে ভুয়ো সংস্থায় টাকা লেনদেন, ২০১টি শিখন্ডী সংস্থা চালানোর নজির গড়েছেন একদা তৃণমূলের এই মহাসচিব।
প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতে সিবিআইয়ের চার্জশিটে থাকা আরেক কীর্তিমান হলো তৃণমূল ঘনিষ্ঠ প্রোমোটার অয়ন শীল। অয়ন শীলের সূত্রেই সামনে এসে পৌরসভার নিয়োগ দুর্নীতিও। ২০১২-১৪’ দুটি টেটেই বিপুল পরিমাণ টাকা তুলেছিল ধৃত অয়ন শীল। ৪৫ কোটি টাকা তুলেছিলেন শুধু ২০১২-১৪’র টেট থেকে। পৌরসভার নিয়োগ দুর্নীতির চার্জশিটেও অভিযুক্ত হয় এই অয়ন শীল। তৃণমূল সরকারের আসার পরে অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ শান্তনু ব্যানার্জির ‘বন্ধু’ অয়ন শীলের সংস্থাকেই পৌরসভার নিয়োগের ক্ষেত্রে থার্ড পার্টি এজেন্সি হিসাবে চিহ্নিত করেছিল সরকার। রাজ্যের অধিকাংশ পৌরসভায় নিয়োগের বরাত পেয়েছিল ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের সংস্থা। তার বাড়িতেই তল্লাশি চালিয়ে টেটের নথি, পরীক্ষার্থীদের অ্যাডমিট কার্ড পর্যন্ত উদ্ধার হয়। এক প্রোমোটার যুক্ত প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতেও রাজ্যের শিক্ষার হালের যথাযথ ছবিই এটা।
এদিকে নিয়োগ দুর্নীতিতে ইডি’র মামলার চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া চলাকালীন মামলা থেকে নতুন করে অব্যাহতি চাইলো তৃণমূলের যুবনেতা কুন্তল ঘোষ। এর আগে পার্থ চ্যাটার্জিও মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেছিল। শুক্রবার আদালতে মোট ১১ জন ইডির মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকটি সংস্থাও রয়েছে। এই মামলায় চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইডি। দুদিন ধরে চলছে তারই শুনানি।
Comments :0