Cpim jalpaiguri rally

দুষ্কৃতীদের ছাড়, জলপাইগুড়িতে পার্টিনেতাদের জেল হেপাজত, ক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিবাদ মিছিলে স্তব্ধ শহর

জেলা

পুলিশের চোখের সামনে সিপিআই(এম)’র জলপাইগুড়ি জেলা দপ্তর সুবোধ সেন ভবনে হামলার পরেও পুলিশ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তারের বদলে সিপিআই(এম)’র ৫ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিল বুধবার রাতে। সারা রাত থানায় বসিয়ে রেখে বৃহস্পতিবার তাঁদের নামে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করে আদালতে তোলায় ১৪ দিনের জেল হেপাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সিপিআই(এম) নেতাদের মুক্তি না দিয়ে জেলে পাঠানোর ঘোষণা শোনামাত্র বামফ্রন্ট ও জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। জেলা বামফ্রন্ট কার্যালয় সুবোধ সেন ভবনের সামনে থেকে হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদ মিছিল জলপাইগুড়ি শহর পরিক্রমা করে পুলিশের দলদাসত্বের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলে। জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানার দিকে মিছিল এগলে পুলিশ ব্যারিকেড করে মিছিলের পথ আটকায়। 
বুধবার রাতে জলপাইগুড়ি শহরে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ দুষ্কৃতীদের জড়ো করে এসএফআই’র জেলা দপ্তর দখল করার নামে সিপিআই(এম)’র জেলা দপ্তর সুবোধ সেন ভবনে হিংসাত্মক হামলা চালিয়েছে। পুলিশের উপস্থিতিতে পরিকল্পিতভাবে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা লাঠি, পাথর, কাচের বোতল ইত্যাদি নিয়ে এসে সুবোধ সেন ভবনে দীর্ঘসময় ধরে হামলা চালিয়েছে। এসএফআই কর্মীরা এই হামলা প্রতিহত করতে গিয়ে গুরুতর জখম হয়েছেন, কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গোটা ঘটনা পুলিশের চোখের সামনে ঘটা সত্ত্বেও পুলিশ হামলাকারী তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তার না করে কেবল কয়েকজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় এবং রাতেই তাদের ছেড়ে দেয়। উলটে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জিয়াউল আলম, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পীযূষ মিশ্র, পার্টির জেলা কমিটির সদস্য তমাল চক্রবর্তী, এবিটিএ’র জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক প্রসেনজিৎ রায়, এবিপিটিএ’র এর জেলা নেতা জ্যোতি বিকাশ করকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সারারাত তাঁদের থানায় বসিয়ে রেখে পুলিশের ওপর হামলা সহ বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে মামলা দায়ের করে পুলিশ। সকালে অসুস্থ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জিয়াউল আলম সহ পার্টি নেতৃবৃন্দকে মেডিক্যাল পরীক্ষা করানোর পর দুপুর একটা নাগাদ জলপাইগুড়ি জেলা আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। 
এদিন দুপুরে পুলিশ ধৃত সিপিআই(এম) নেতৃত্বকে জলপাইগুড়ির চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে তুলে তাঁদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় সাজানো অভিযোগ তোলে। পুলিশকে আক্রমণ এবং আহত করার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে পার্টি নেতাদের নামে। অথচ আদালতে পুলিশের পক্ষ থেকে আহত পুলিশ কর্মীদের ইনজুরি রিপোর্টও দাখিল করতে পারেনি। এসত্ত্বেও পুলিশের আবেদনে পার্টি নেতাদের ১৪ দিনের জেল হেপাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। পাশাপাশি আগামী ২১ তারিখ পুলিশকে কেস ডায়েরি ও আহত পুলিশ কর্মীদের ইনজুরি রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জলপাইগুড়ি জেলা আদালতের অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর প্রদীপ চ্যাটার্জি। জেলা আদালতে আটক পার্টি নেতৃবৃন্দের হয়ে সওয়াল করেন প্রাক্তন পাবলিক প্রসিকিউটর আইনজীবী জিতেন বোস সহ এআইএলইউ’র আইনজীবীরা।
এদিকে বুধবার রাতেই হামলা ও পার্টি নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে জেলা দপ্তরে ছুটে আসনে বহু পার্টিকর্মী। রাতেই থানায় আটক পার্টি নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে যান প্রাক্তন সংসদ জিতেন দাস, সকালে দেখা করেন পার্টির জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য, জলপাইগুড়ি শহরের সদর পূর্ব এরিয়া কমিটির সম্পাদক বিপুল সান্যাল সহ পার্টির নেতৃবৃন্দ। পার্টি নেতাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে শুনে শিলিগুড়ি থেকে ছুটে আসেন সিপিআই(এম)’র দার্জিলিঙ জেলা সম্পাদক সমান পাঠক সহ পার্টির নেতৃবৃন্দ। জলপাইগুড়ি জেলা আদালতে ধৃত পার্টি নেতৃবৃন্দকে তোলার সময়েও সেখানে উপস্থিত ছিলেন পার্টি নেতৃবৃন্দ। জেলা দপ্তরে তৃণমূলী হামলা এবং পার্টি নেতৃত্বকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার শিলিগুড়ি সহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে প্রতিবাদ ও ধিক্কার কর্মসূচি পালন করা হয়। এদিন শিলিগুড়িতে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জীবেশ সরকার সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছেন, অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও নিন্দনীয় ঘটনা। ২০১৩ সালে একই কায়দায় তৃণমূলীরা মিছিল করে পুলিশকে সাথে নিয়ে শিলিগুড়িতে হিলকার্ট রোডে সিপিআই(এম)’র জেলা দপ্তর অনিল বিশ্বাস ভবনে আক্রমণ চালিয়েছিল। জেলা পার্টি দপ্তরে ভাঙচুর করে পার্টি নেতৃত্ব সহ মোট ৫২জনকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করেছিল। সেই অভিজ্ঞতা আমাদের স্মরণে আছে।
এদিন দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার শেষেও পার্টি নেতাদের জামিন মঞ্জুর হয়নি শুনে জলপাইগুড়ি জেলা সিপিআই(এম) দপ্তরে জড়ো হওয়া বামফ্রন্ট ও জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সন্ধ্যায় জেলা বামফ্রন্ট কার্যালয় সুবোধ সেন ভবনের সামনে থেকে হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদ মিছিল বের হয় ‘পুলিশ তুমি উর্দি ছাড়ো, তৃণমূলের ঝান্ডা ধরো’ স্লোগান তুলে। সিপিআই(এম) কর্মীদের সঙ্গে মিছিলে পা মেলান বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির এবং কংগ্রেসের কর্মীরাও। মিছিল শহর পরিক্রমা করে জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানার দিকে এগলে পুলিশ থানার সামনে ব্যারিকেড তৈরি করে। ক্ষোভে উত্তাল প্রতিবাদী মিছিলকে ঠেকাতে ব্যারিকেডের সামনেই এদিন র্যা্ফ এবং সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা ছিল। অথচ বুধবার রাতে আগাম হামলার খবর থাকা সত্ত্বেও সুবোধ সেন ভবনে পুলিশকে স্রেফ নিষ্ক্রিয় করে পুতুলের মতো দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল। এদিন থানার সামনে পুলিশের ব্যারিকেডের সামনেই বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা কোনরকম প্ররোচনায় পা না দিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ চালিয়ে যান। মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করে পার্টি নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবি তোলেন বাম কংগ্রেস কর্মীরা। এই বিরাট মিছিলে জলপাইগুড়ি শহর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় স্তব্ধ হয়ে যায়। মিছিলে অংশ নেন ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সভাপতি গোবিন্দ রায়, সিপিআই(এমএল) নেতা প্রদীপ গোস্বামী, জাতীয় কংগ্রেসের জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি পিনাকী সেনগুপ্ত, সিপিআই(এম)’র জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদকমণ্ডলী সদস্য কৌশিক ভট্টাচার্য, আরএসপি’র জেলা নেতা প্রকাশ রায় সহ বাম কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ। 
সিপিআই(এম)’র জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য বলেছেন, গণতন্ত্রে বিশ্বাস থাকলে কোনও রাজনৈতিক দল অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের অফিসে এইভাবে হামলা চালাতে পারে না। কিন্তু শাসক দলের ওপর মহলের চাপে পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেপ্তার না করে আমাদের পার্টি নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করেছে। সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে এই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার না করলে আগামী দিনে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই আরও তীব্র হবে দলদাস পুলিশের বিরুদ্ধে।
মিছিল শেষে জেলা বামফ্রন্ট দপ্তরের সামনে সিপিআই(এম)’র জেলা সম্পাদকমণ্ডলী সদস্য কৌশিক ভট্টাচার্য বলেন, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কিছু দুষ্কৃতী পাঠিয়ে বুধবার সিপিআই(এম)’র জেলা কার্যালয় দখল করার কথা ভেবেছিল তৃণমূল। এসএফআই কর্মীরা ও পার্টিকর্মীরা গতকাল তাদের প্রতিরোধ করেছেন সাহসের সঙ্গে। আসলে ওদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে বলেই সিপিআই(এম) জেলা দপ্তরে হামলা করেছে। তারপরেও পুলিশ সিপিআই(এম) নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। আমরা বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সকলকে আবেদন রাখছি কেউ পুলিশের প্ররোচনায় পা দেবেন না, আমরা আইনি লড়াই লড়ব, সেই সঙ্গে রাস্তায় লড়াইতেও থাকব। বাম কংগ্রেসের কয়েক ঘণ্টার ডাকে আজকে মিছিল করে জলপাইগুড়ি শহরে প্রমাণ করেছে মানুষ প্রতিবাদের ভাষা ভুলে যায়নি। 

Comments :0

Login to leave a comment