বুলডোজার ত্রিপুরা দেখেছিল পাঁচ বছর আগে। বাকি দেশ এখন দেখছে। জয়ের উল্লাসে সঙ্ঘবাহিনী বুলডোজারে উপড়ে ফেলেছিল লেনিনের মূর্তি। জান্তব উল্লাসের ছবি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে কমিউনিজমের ‘সমাপ্তি’ ঘোষণা করা হয়েছিল সোভিয়েতের সঙ্গে তুলনা করে।
বিলোনিয়ার সেই কলেজ স্কোয়ার থেকে মুহুরী নদী পেরিয়ে রাস্তা গিয়েছে বিলোনিয়া নেতাজী পল্লিতে। প্রৌঢ় দীনেশ দেবনাথের বাড়ি। ১৯৮৯ সালে জোট আমলে ঘাতক বাহিনীর হাতে নিহত হয় তাঁর আপন ভাই নীরেশ দেবনাথ, জ্যেঠতুতো ভাই স্বপন দেবনাথ। কুখ্যাত নলুয়া হত্যাকাণ্ডে দুই ভাইয়ের সঙ্গে নিহত হন সুশীল মহাজন, মানিক মগ। ‘নীরেশের মাথার চুল সব উপড়ে নিয়েছিল, মুণ্ড আর ধর আলাদা জায়গায় পুঁতেছিল, দুটো হাত কেটে নিয়েছিল। নৃপেন চক্রবর্তী এসে প্রবল চাপ তৈরি করার পরে অনেক দিন পর ভায়ের পচাগলা দেহ মেলে।’ গলা ধরে এল, চোখ মুছলেন শহীদের বড়দা।
সেই কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা? প্রশ্ন শুনে সরাসরি তাকালেন। বললেন, ‘প্রথমে শুনে অস্বস্তি হয়নি, একথা অস্বীকার করবো না। তারপর মনে হয়েছে অন্য কোনও পথ নাই। জোট আমলের অত্যাচারের থেকে বিজেপি’র আমল যে কত ভয়ঙ্কর তা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। ৯০ সালেও নলুয়ায় ভাইকে শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছি। ২০১৮ সালের পর থেকে আর পারি নাই। জোট আমলে সন্ত্রাস চোখে দেখা যেত, এখন নীরব সন্ত্রাস। সর্বক্ষণ মনে হয় পিছনে কেউ আছে, ছায়ার মতো।’
সেই সন্ত্রাস কেমন, ব্যাখ্যা দিলেন প্রতিবেশী খোকন পাল। ‘আরএসএস-বিজেপি বলে মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করবে। আর তারা এখানে কমিউনিস্টদের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রেখেছে। জোট আমলের মতো খুন করে ফেলছে না, কিন্তু মানসিক, আর্থিক আক্রমণ সীমাহীন। বাইক বাহিনী বাড়ি ঘিরে এমন পরিস্থিতি করে দিচ্ছে যাতে পরিবার থেকেই চাপ তৈরি হয় লাল ঝান্ডা ছেড়ে দেওয়ার। বিয়ে, শ্রাদ্ধের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে সিপিআই (এম) পরিবারগুলিকে বয়কট করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে প্রতিবেশীদের।’ দীর্ঘ বিবরণের মধ্যেই শহীদের বড়দা ফের বললেন, ‘ভাইয়ের মৃত্যুর কষ্ট প্রতিদিন হয়। কিন্তু মগজের এই সন্ত্রাস অসহ্য হয়ে গেছে। এর থেকে মুক্তি পেতে সবাইকে এক জায়গায় চাই।’ একই কথার প্রতিধ্বনি শহীদ প্রিয়লাল শীলশর্মার ভাইপো সঞ্জয় শীলশর্মার। তখন এগারোর সঞ্জয়ের স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা। বললেন, ‘জোট রাজত্বের খুনিগুলি তো এখন সব বিজেপিতেই।’
ত্রিপুরার অন্য অংশের মতই বিলোনিয়া মহকুমা জুড়ে আক্রান্ত হয়েছে বামপন্থীরা। অজস্র পার্টি অফিসে ভাঙচুর-আগুন ধরানো, মিছিলে হামলা। প্রাক্তন মন্ত্রী, এখনও বিলোনিয়ার ঋষ্যমুখের বিধায়ক প্রবীণ, অসুস্থ বাদল চৌধুরির উপরও হামলা করতে পিছপা হয়নি গেরুয়া বাহিনী। মহকুমা সম্পাদক তাপস দত্ত বারেবারে আক্রান্ত হয়েছেন। বিলোনিয়া কেন্দ্রের প্রার্থী দীপঙ্কর সেন সহ মহকুমা কমিটির প্রতিটি সদস্য শারীরিকভাবে অথবা বাড়িঘর আক্রান্ত হয়েছে। সর্বোচ্চ নেতাদের উপর যদি আক্রমণের এই বহর হয়, তাহলে বুথ স্তরের কর্মীদের অবস্থাটা কী হয়েছে সহজেই অনুমেয়।
‘লেনিন মূর্তি না বাঁচে তো গান্ধীও কি বাঁচবে?... গান্ধী মূর্তি না বাঁচে তো সুভাষও কি বাঁচবে?...ওদের নাচন ওদের মাতন ঐখানে কি থামবে?’ না, থামেনি। কমিউনিস্টদের উপর শুরু হওয়া আক্রমণ ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে কংগ্রেস সহ অন্য বিরোধীদের উপরে। এখানের কংগ্রেস নেতা তমাল ধর সহ অনেকে আক্রান্ত। এমনকি বিলোনিয়ার বিজেপি’র বর্তমান বিধায়ক অরুণচন্দ্র ভৌমিকের পরিবারও ছাড় পায়নি। তাঁর মেয়ে-জামাই ত্রিপুরা মেডিক্যাল কলেজের দুর্নীতি নিয়ে সরব হওয়ায় চূড়ান্ত হেনস্তা করা হয়েছে তাঁদের। তার জেরে বিধায়কও টিকিট পাননি এবার। বিধায়কের মেয়ে রামনগর কেন্দ্রে বাম সমর্থিত নির্দল প্রার্থীর হয়ে প্রচার করছেন। প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘বামবিরোধী হয়েও বাম আমলে চাকরি পেয়েছিলাম। আর এখন দুর্নীতির প্রতিবাদ করার শাস্তি পাচ্ছি।’ বিজেপি’র জুলুমে বন্ধ হয়ে গেছে বহু পুরানো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। নানাভাবে আক্রান্ত সাধারণ মানুষ। এখনও বাড়ি বাড়ি হুমকি চলছে,‘মিছিলে চলো, নাহলে ভাতা-টাতা পাইতা না।’
সর্বগ্রাসী এই আক্রমণে শ্বাস নিতে চাইছে বিলোনিয়া, ত্রিপুরা। বিলোনিয়া কেন্দ্রের প্রার্থী দীপঙ্কর সেন জানালেন, ‘কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। ১৬টা বুথে প্রকাশ্যে কোনও কাজ করতে পারতাম না। সবগুলিই গ্রামীণ এলাকায়। লাউগাঙ, বেথাগার মতো গ্রামে সবথেকে বেশি সন্ত্রাস ছিল। এখন সবগুলি জায়গায় বিজেপি’র ৪০-৫০ জন থাকলে আমাদের ২০০ লোক। হামলা করার সাহস পাচ্ছে না।’ প্রায় পাঁচ বছর পরে বিলোনিয়ায় প্রথম কেন্দ্রীয়ভাবে মিছিল হয়েছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন।
নগদায় মগ উপজাতিদের বাস। তীব্র সন্ত্রাস। বুধবার বিকেলে বাজারে মিছিল, সভা করলো সিপিআই (এম)-কংগ্রেস। দলীয় অফিসে থাকলেও হামলার সাহস পায়নি বিজেপি, কারণ উলটোদিকের জমায়েতটা ছিল অনেক বেশি। জোট আমলের শহীদ প্রদীপ চক্রবর্তীর ছোট ভাই সজীব চক্রবর্তী বলেন, দেওয়ালে পিঠ থেকে গেছে মানুষের। জড়তা ছেড়ে এবার তাই প্রকাশ্যেই তারা বেরিয়ে আসছে।
একই ঘটনা ঘটেছে মঙ্গলবার রাতে রামঠাকুর পাড়ায়। পতাকা লাগাচ্ছিলেন ছাত্র-যুব কর্মীরা। সঙ্গে ছিলেন দুই কংগ্রেস কর্মীও। খবর পেয়ে চারদিক থেকে জড়ো হয়ে যায় জনা তিরিশেক বিজেপি কর্মী। সংখ্যায় কম থাকলেও বাম-কংগ্রেস কর্মীদের জঙ্গি মনোভাব দেখে সরে পড়ে। এই পরিবর্তনটাই বিজেপি’র মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। ছাত্র-যুব কর্মীদের অভিযোগ, রাজ্যে আসা নিরাপত্তা বাহিনীকে দর্শকের মতো বসিয়ে রাখা হয়েছে। তারা টহলদারি করলে বিজেপি দুষ্কৃতীরা ভয় দেখানোর সুযোগ পায় না।
বিজেপি’র ‘নীরব সন্ত্রাস’এর জেরে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন যুবনেত্রী প্রতিমা দত্ত। হাপানিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রায় ৮৫ কিমি পথ উজিয়ে প্রতিমা বিলোনিয়া আসছেন ভোটের কাজে। শারীরিকভাবে অশক্ত বাদল চৌধুরি মিছিলে হেটেছেন। তাঁর সেই ভিডিও বিলোনিয়াজুড়ে মানুষের মনে জেদ তৈরি করেছে। তিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধা প্রদ্যুৎকণা চক্রবর্তী ছেলেকে বলেছেন, ভোট দিতে আমার সঙ্গে যাবি! দেখি কে ভোট দিতে না দেয়। সন্ধ্যার পরে বাইক বাহিনীর দাপটে রাস্তায় থাকা যেত না। সেখানেই গভীর রাত পর্যন্ত অলি-গলিতে লাল ঝান্ডা লাগাচ্ছে তরুণরা।
নলুয়া, বীরচন্দ্রমনুর ভয়াবহ সন্ত্রাসের বিলোনিয়ায় বুলডোজারে উপড়ে ফেলা লেনিন মূর্তি আর নেই। তার চারপাশে ফুলের বাগান করা হয়েছিল। বুধবার বিকেলে কলেজ স্কোয়ারে পৌঁছে দেখা গেল, লেনিন মূর্তিকে ঘিরে লাগানো সেই সব গাছে নতুন করে ফুল ধরেছে।
Comments :0