Aboltabol post editorial

‘আবোল তাবোল’: যেন এখনেরই ছবি

সম্পাদকীয় বিভাগ

শান্তনু চক্রবর্তী
‘‘কবি সুকুমার রায়ের রচনার অননুকরণীয় বৈশিষ্ট্য শিশুকাল থেকে আমাকে টেনেছে। শৈশবে, বাল্যে — এমনকি প্রথম যৌবনে যে সব কবি ও সাহিত্যিকদের লেখা আমার ভালো লাগত, তাঁদের অনেকেরই রচনা সম্পর্কে আগেকার সেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু সুলুমার রায়ের লেখা- প্রধানত তাঁর কবিতা— বিশেষ করে তাঁর ‘আবোল তাবোল’ বইটি সম্বন্ধে আমার এবং আশা করি প্রায় সকলেরই আগ্রহ এখনও প্রচুর। বইখানি বিশেষ কোনও সময়ে সৃষ্টি হয়েও সময়োত্তীর্ণ বিশেষত্বে প্রদীপ্ত।’’ সিগনেট প্রকাশনের কর্ণধার দিলীপকুমার গুপ্তকে একটি চিঠিতে কথাগুলো লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। যাঁর নিজের কবিতায় আলো-আশা-জীবন-উষ্ণতার চে‍‌য়েও মৃত্যু আঁধার হিম নৈরাশ্যের বাড়াবাড়ি বলে সময়কালের অভিযোগ ছিল, ছন্দ-আনন্দের কবি, অদ্ভুত আর খেয়ালরসের ভিয়েনদার সুকুমার রায়ের প্রতি তাঁর এই পক্ষপাত, অনেককে হয়তো অবাক করতে পারে। কিন্তু ‘আবোল তাবোল’ নিয়ে তাঁর মুগ্ধতার ব্যাপারে জীবনানন্দ কোনও অস্পষ্টতা রাখেননি।


১৯৪৩ সালের ৩০ অক্টোবর সুকুমার রায়ের ৫৬তম জন্মদিনে জীবনানন্দ যখন এই চি‍‌ঠি লিখছেন, তখন ‘আবোল তাবোল’ প্রকাশের ২০ বছর সদ্য পার হয়েছে। এবং সেই ‘বিশ বছর পরের একদিন’-এও ‘আবোল তাবোল’-কে প্রথমবার পড়ার মতোই নতুন আর সজীব লাগছে কবির। তারও ৮০ বছর পরে আজকে ২০২২ সালের এই শেষ প্রহরে এসেও ‘আবোল তাবোল’-কে কিন্তু‍‌ একটুও পুরানো লাগে না।
‘সময়োত্তীর্ণ’। আবোল তাবোল সম্পর্কে শব্দটা খুব সার্থক আর সচেতনভাবেই ব্যবহার করছিলেন জীবনানন্দ। কারণ ‘আবোল তাবোল’ সেই আশ্চর্য দ্বীপের মত — একই পথে বার বার হাঁটার পরেও যেখানে নতুন কিছু আবিষ্কারের সুযোগ থেকে যায় প্রতি মুহূর্তে! শতবর্ষ ছুঁয়ে ফেলা এই বইটা তাহলে আমরা কিভাবে পড়ব? সেই গাইড লাইনটা বইয়ের ভূমিকায় দিয়ে গেছেন সুকুমার। তাঁর মৃত্যুর মাত্র ৯ দিন পরেই প্রকাশিত হয়েছিল ‘আবোল তাবোল’। বইয়ের ‘ডামি’ কপিটা দেখে যেতে পেরেছিলেন। ভূমিকা লেখার সুযোগটাও তাই পেয়েছিলেন। তবে সেটাকে ভূমিকা না বলে ‘বিধিসম্মত সতর্কীকরণ’-ও বলা যায়। সুকুমার লিখছেন, ‘‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়ালরসের বই। সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।’’ তার মানে পরিষ্কারভাবে পাঠের অধিকার আর অনধিকারীর শ্রেণি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি আমরা সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আর সুকুমারকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর তুলনামূলক আলোচনাটাও রাখতে পারি। বুদ্ধদেব সেখানে বেশ তির্যক ভঙ্গিতেই সত্যেন্দ্রনাথের ছন্দের নেশাকে ঠেস দিয়ে বলেছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ বড়দের জন্য লিখলেও, তাঁর কবিতা পড়ে ছোটরা বেশি আনন্দ পায়। সেখানে সুকুমার ছোট‍‌দের লেখক হিসাবে চিহ্নিত হলেও, তাঁর লেখা পড়ে আনন্দ পায় বড়রাও।


ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। সত্যেন্দ্রনাথ ছন্দ নিয়ে অনেক কসরৎ করলেও আসলে শিশুতোষ পদ্যই উৎপাদন করে গেছেন —সিধে-সরল সেসব কাব্যচর্চার সাদা মনে কোনও কাদা নেই, কিন্তু  সুকুমারীয় ‘আবোল তাবোল’-এ শিশুপাঠ্যের ভাঁজে ভাঁজে অনেক রকম শরসন্ধান — যার আসল চাঁদমারি প্রাপ্তমনস্কদের মগজ। সুকুমার রায় নিজে অবশ্যই এইসব ছোটদের-বড়দের বিভাজন করেননি। বরং সব ব্যাপারে তত্ত্বের তল্লাশে থাকা, হুঁকোমুখো জটিল সিরিয়াস ‘গোমড়া থেরিয়াম ’ প্রাপ্তবয়স্করা ‘আবোল তাবোল’-এর কতটা কদর করতে পারবে, সে ব্যাপারে নিজের সংশয়টা তো ঠারে ঠোরে ভূমিকাতেই জানিয়ে দিয়েছেন! ভূমিকাতেই আজও বলা আছে ‘‘পুস্তকের অধিকাংশ ছবি ও কবিতা নানা সময়ের ‘সন্দেশ’ পত্রিকা হইতে সংগৃহীত হইয়াছে।’’ তার মানে আবোল তাবোল-এর কবিতারা ঘোষিতভাবেই শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত — কিন্তু বড়রাও পড়ে ফেলতে পারেন, এই আশা ও আশঙ্কা সুকুমারের ছিল। অন্যদিকে তাঁর উদ্ভট বা ‘খেয়ালরসের’ উৎস সন্ধানে সাহিত্য-গবেষণা প্রায়ই এডোয়ার্ড লিয়ার ও লুইস ক্যারল অবধি পৌঁছে যায়। সাহিত্যতাত্ত্বিকরা বলেন,শিল্প বিপ্লব-উত্তর ইংল্যান্ডে, বি‍‌শেষ করে ভিক্টোরীয় যুগের ভয়ানক পিউরিটান উপযোগিতাবাদের আমলে, মানুষের মন, সমাজ, সংস্কৃতির ওপরে নিয়ম, শৃঙ্খলা আর যান্ত্রিকতার যে দমবন্ধ করা ফাঁস চেপে বসেছিল, লিয়রের ‘লিমেরিক’ ও ‘ননসেন্স’-এর জগৎ ছিল তারই সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। নিয়ম আর যুক্তির, নিগড় আর শৃঙ্খল, ভেঙে-ছিঁড়ে-ফাটিয়ে বেরিয়ে আসার ছটফটানি আর অন্তর্ঘাত ছিল লুই ক্যারলের রচনাতেও। সুকুমারের ‘‘মত্ত মাদল বা‍জিয়ে’’, ‘‘স্বপনদোলা নাচিয়ে’’, ‘‘সৃষ্টিছাড়া নিয়মহারা হিসাবহীন’’ হওয়ার আহ্বানে অবশ্যই সেই বিদ্রোহের বীজ ছিল।


কিন্তু আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, লিয়র বা ক্যারলের সৃষ্টির পটভূমি-প্রেক্ষিত আর ‘আবোল তাবোল’-এর পৃথিবী, ঐতিহাসিকভাবেই আলাদা। সুকুমারের স্বদেশে কোনও শিল্প বিপ্লব হয়নি। বুর্জোয়া পুঁজির তখন শৈশব। কৃষি ও ভূমি ব্যবস্থায় সামন্ততন্ত্রের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। সেই ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের রাজধানী শহর থেকে অনুন্নয়নের গোলার্ধ থেকে সুকুমার শিল্প বিপ্লবের পীঠস্থান ব্রিটেনে গেলেন আধুনিক, বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য। তিনি যখন বিলেত থেকে ফিরছেন তখন পরাধীন দেশের রাজধানী, তাঁর প্রিয় শহর থেকে, ছিটেফোঁটা যেটুকু নাগরিক গরিমা সবটা শুদ্ধু দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি প্রতিরোধ-প্রতিবাদের পথ খুঁজে খুঁজে হয়রান, বিভ্রান্ত। তাঁর নিজের চেনা চারপাশের ইংরেজি শিক্ষিত নাগরিক এলিট সমাজ, কত দূর সাহেব হবে আর কতটা বাঙালিয়ানা বজায় রাখবে, সেই আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে দুলছে — যেকোনও ঔপনিবেশিক সমাজই  যেমনটা ভুগে থাকে! আর যে ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের সঙ্গে তাঁরা পারিবারিকভাবে যুক্ত, একটা সময় বাংলাদেশে বিভিন্ন সামাজিক পরিবর্তনে তাদের যথেষ্ট প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল, সেই আন্দোলনও তখন গতি হারিয়েছে, নানারকম নিয়ম-আচার-প্রথা পালনের তুচ্ছ তর্ক আর নিরর্থক দলাদলি কূটকচালিতে মগ্ন।
নিজের চারপাশেই যখন এত রকমের ‘‘আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল’’, তখন তাঁর ‘‘অসম্ভবের ছন্দ’ তো সঠিক প্রতিপক্ষ খুঁজে নেবেই। সে আবোল তাবোল ‘খ্যাপার গানে’র কারবারে আপাতভাবে যতই ‘‘নাইকো মানে নাইকো সুর’’ মনে হোক, একদম প্রথম কবিতা থেকেই সুকুমার এই ‘হাঁসজারু’ ঔপনিবেশিক সমাজের ‘বকচ্ছপ’ মূর্তিটাকে চেনাতে চেনাতে ‌আর বিঁধতে বিঁধতে গেছেন। এইসব শব্দ বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক অভিধানে ঢুকে গেছে। নৈতিকতা, স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে গিয়ে জোর করে কিছু চাপিয়ে, জু‍ড়ে দেওয়াটাকে লোকে এখনও হাঁসজারুই বলে। সেটা সরকারি প্রকল্পই হোক কিংবা রাজনৈতিক জোট। আবোল তাবোল-এর পাতায় পাতায় এমন অনেক চরিত্র-ঘটনা-পরিস্থিতি আবছায়া হয়ে আলতো করে উঁকি দিয়ে গেছে, যেগুলো সেই সময়ের এবং সব সময়ের। চাইলেই ননসেন্স-এর মোড়ক ছাড়িয়ে তাদের দেখে চিনে নেওয়া যায়। না চাইলেও কবিতা উপভোগে কোনও সমস্যা নেই। যেমন ‘কিম্ভূত’ কবিতাটার শেষ স্তবকের সাংঘাতিক আইডেনটিটি সঙ্কট নই ঘোড়া, নই হাতি, নই সাপ বিচ্ছু/ মৌমাছি, প্রজাপতি নই আমি কিচ্ছু। মাছ, ব্যাঙ, গাছপাতা জলমাটি ঢেউ নই/ নই জুতা নই ছাতা, আমি তবে কেউ নই!’’ এটা ঔপনিবেশিক ভারতে যেমন সত্যি, এই গ্লোবাল দুনিয়াতেও তো তাই। নিজস্বতা খুইয়ে বসা, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের নকলনবিশি করা ‘ট্যাঁশ গোরু’দের শুধু ‘হারুদের অফিসে’ নয় — অনেক জায়গাতেই দেখা যায়।


সুকুমারের পৃথিবীতে ‘‘ধমক দিসে ঠাসা’’ রামগরুড়ের বাসার ঠিকানাটা হয়তো ব্রাহ্ম সমাজের সদর দপ্তরের সঙ্গে মিলে যায়। অতি পিউরিটান, অতি ছ্যুৎমার্গী, অতি রক্ষণশীল সমাজপতিরা যেখানে হাসির ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসেন।
অথচ সুকুমার তো ছোটবেলা থেকেই যে কোনো বেঢপ, বিসদৃশ বেয়াপড়াপনা কিংবা বেমক্কা, বেআক্কেলে দাদাগিরিকে হেসে উড়িয়ে, তুড়িয়ে, ‘খিলখিল্লের মুল্লুকে’ পা‍‌ঠিয়ে দেওয়ার চর্চা করে এসেছেন। বৈজ্ঞানিকের মন আর শিল্পী কবির হৃদয় নিয়ে তিনি পৃথিবীকে দে‍‌খেছিলেন। তাই সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতির নানারকম ফাঁকফোকর, গোলমাল, আ‍‌পস, স্ববিরোধিতাকে খেয়াল করে ডুবিয়ে, চুবিয়ে একসা করে ছেড়েছেন। পাগলা জগাইকে সুকুমার তাঁদের গড়পাড়ের বাড়ির রাস্তায় কখনো দে‍খেছিলেন কিনা জানা নেই। তবে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ যে আসলে উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মাদ অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া কিচ্ছুই নয়, ‘লড়াই-ক্ষ্যাপা’র  ২২পঙ্‌ক্তিতেই সুকুমার সেটা প্রমাণ করে দেন। পাগলা জগাই তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জার্মানিতে কাইজারের রাজপ্রাসাদে থাকতে পারে। কিংবা আজকের পুতিন-জেলেনেস্কির রাশিয়া বা ইউক্রেনেও তাকে দেশপ্রেমের দিন মজুরি করতে দেখা যেতে পা‍রে। যেমন বোম্বাগড়টা ভূগোলের মানচিত্রে কোথাও না থাকলে‍‌ও সেখানকার রাজা বা রানি মা-কে আপনি নোটবন্দির ভারতে বা নবান্নর চোদ্দতলার কোনও খামখেয়ালিপনায় চিনে নিতে পারেন। কুমড়োপটাশ যে ছমছমে আতঙ্ক আর সন্ত্রাস কবিতা জুড়ে ছড়িয়ে রাখে, সে তো যে কোনও স্বৈরশাসনের মত। ‘একুশে আইন’-এ শিবঠাকুরের যে আপন দেশের কথা বলা হয়েছে, সেটা যেমন রাওলাট আইনের আমলের ব্রিটিশ-ভারত হতে পারে, জরুরি অবস্থার কালের ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’ হতে পারে, আবার মোদী-জমানার কালাকানুনে শ্বাসরুদ্ধ আজকের ভারতও হতে পারে।


‘আবোল তাবোল’-কে তাই বারবারই, ফিরে ফিরে নতুন করে পড়তে হয়। ‘বাবুরাম সাপুড়ে’-র দুধভাত খাওয়া, নির্বিষ, নিরুৎপাত, ‘অহিংস’ সাপেরা কংগ্রেসী নরমপন্থী রাজনীতির মেটাফর কিনা, সে তর্ক চলতেই থাকবে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সামনে, কর্পোরেট তার ‘দাসেদের’ সামনে ‘খুড়োর কল’ ঝুলিয়েই রাখবে! ‘ভয় পেয়ো না’-র মুগুরধারী সেই অদ্ভুত জন্তু, সদাশয় সরকার সেজে একই সঙ্গে অভয় দিতেই থাকবে — ভয় দেখাতেই থাকবে। আসলে জীবনানন্দ যেমনটা বলেছিলেন : ‘‘সুকুমার রায়ের পৃথিবী — ‘আবোল তাবোল’-এ যা সত্য হয়ে ফুটে উঠেছে তা মোটেই আমাদের চেনাজানা পৃথিবী কিংবা তার প্রতিচ্ছবির মতো বাস্তব না হয়েও তেমনই পরিচিত  ও তেমনি সত্য’’। আর এখানে লিয়রদের হারিয়ে সুকুমারের খেয়ালরসের জিত।

Comments :0

Login to leave a comment