আরও একটু এগিয়ে গেলেই চৌরাস্তা ট্র্যাফিক গার্ড। সেখানে তখনও সার দিয়ে রাখা রয়েছে একাধিক পোড়া বাইক। প্রবল ক্ষোভে উত্তেজত জনতা পুড়িয়ে দিয়েছে পুলিশের বাইক। ইতিউতি পুলিশের জটলা। একাধিক প্রিজন ভ্যান।
স্কুলের সামনে থাকে না ট্র্যাফিক পুলিশ, অন্যতম ব্যস্ত এই রাস্তায় প্রতিদিন প্রাণ হাতে পারাপার করতে হয় খুদেদের। দীর্ঘদিনের এই ক্ষোভ আর বাধা মানেনি শুক্রবার। পুলিশ যদিও ঝাঁপিয়ে পড়েছে প্রতিবাদী জনতার ওপর। চলেছে লাঠি। আটকও রয়েছেন একাধিক। তাঁদের মুক্তির দাবিতে সরব হয়েছেন এলাকাবাসী।
ঠিক একই সময়ে পূর্ব বড়িশার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোডের নবপল্লী এলাকায় শোকের ছায়া, যন্ত্রণা। নবপল্লী খেলার মাঠ থেকে কিছুটা এগিয়ে মূল রাস্তা থেকে একটি শাখা বেরিয়ে গিয়েছে। পাড়ায় হাতে গোনা ৩-৪টি বাড়ি। রাস্তার একদম শেষে সৌরনীলদের বাড়ি। বাড়ির নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করছে ৭ বছরের খুদের উপস্থিতি।
কিন্তু তার মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ শেষবারের মত শববাহী গাড়িতে চড়ে বাড়িতে এল সৌরনীল। তারপর আর তার স্মৃতি ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকার সুযোগ নেই।
শুক্রবার ভোর সাড়ে ৬টা নাগাদ চৌরাস্তা মোড়ে দ্রুতগামী পণ্যবাহী ট্রাকের আঘাতে মৃত্যু হয় সৌরনীল সরকারের। গুরুতর জখম অবস্থায় এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে সৌরনীলের বাবা সরোজ কুমার সরকারের। ঠাকুরপুকুর বাজারে একটি দোকান রয়েছে তাঁর।
ইতিমধ্যেই গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে মর্মান্তিক এই ঘটনার খবর।
সারাদিন ধরেই সৌরনীলের বাড়ির সামনে ছিল প্রতিবেশিদের জটলা। জটলার বক্তব্য, ছেলেটা স্কুলে যেতে খুব ভালোবাসত। এখনও সরকার পরিবারের চোখে ভাসছে, সকালবেলা বাবার হাত ধরে সৌরনীলের স্কুলে যাওয়া। কখনও বাবা আবার কখনও দাদুর সঙ্গে স্কুলে যেত সৌরনীল। বিকেলে খেলতে যাওয়ার সঙ্গী ছিলেন দাদু।
ঘটনার আকস্মিকতায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সৌরনীলের দাদু। কার্যত কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন সৌরনীলের মা দীপিকা সরকার।
বেহালা বিদ্যাসাগর হাসপাতালের বসে ছেলের ব্যাগ আঁকড়ে তাঁর বিলাপ, ‘‘স্কুল থেকে স্যার ফোন করে জানান, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুলে আসুন। খুব দরকার। ছেলেটার পরীক্ষা ছিল সাড়ে সাতটা থেকে। আমি ভাবলাম কিছু হয়ত নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছে। তার কিছুক্ষণ পরে ওর বাবা ফোন করে বলল আমাদের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সব শেষ হয়ে গিয়েছে।’’
সবটা একবারে বা স্পষ্ট ভাবে বলতেও পারছিলেন না দীপিকা সরকার। তাঁকে বিদ্যাসাগর হাসপাতাল থেকে নিয়ে গিয়ে স্কুলের টিচার্স রুমে বসান বড়িশা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
স্কুলের শিক্ষা মহলের অভিযোগ, সকাল ৭টা নাগাদ প্রাথমিক বিভাগের ক্লাস শুরু হয়। প্রাথমিকের পর্ব শেষ হলে শুরু হয় মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের স্তরের ক্লাস। চৌরাস্তা মোড়ে অত্যন্ত জনবহুল। ডায়মন্ড হারবার রোড আদপে জাতীয় সড়ক। কলকাতার সঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার একটা বড় অংশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের মাধ্যম। ছোট গাড়ি এবং বাইকের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বাস এবং ট্রাক সারাদিন ধরেই চলাচল করে স্কুলের সামনে দিয়ে। কিন্তু স্কুলের সামনে ট্র্যাফিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি। চৌরাস্তা মোড়ে ট্র্যাফিক পুলিশ থাকলেও স্কুলের পড়ুয়ারা এবং শিক্ষক শিক্ষিকরা তাঁদের সাহায্য খুব বিশেষ পান না।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের স্পষ্ট অভিযোগ, ১ কিলোমিটারের মধ্যে জেমস লং সরণীর উপর রয়েছে ২টি নামজাদা বেসরকারি স্কুল। তার সামনে আলাদা করে ট্র্যাফিক পুলিশ মোতায়েন থাকে। বড়িশা স্কুলের অভিযোগ, আর্থ সামাজিক ভাবে কিছুটা পিছিয়ে থাকা অংশের পড়ুয়ারাই মূলত বড়িশা স্কুলে পড়াশোনা করেন। আর্থিক সামর্থ্য বিশেষ না থাকার কারণেই কলকাতা পুলিশের তরফে এই স্কুলের সঙ্গে বৈষম্য দেখানো হয়।
এই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
দীর্ঘদিনের এই ক্ষোভই ঘটনার পরে পুলিশের উপর আক্রোশ হয়ে আছড়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, দুর্ঘটনার কারণ ট্রাকটিকে প্রাথমিক ভাবে আটকালেও পরে ছেড়ে দেয় কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা। সেই ক্ষোভ আক্রোশে পরিণত হয়ে আছড়ে পড়ে শহরের রাজপথে। বড়িশা স্কুলের ঠিক সামনে এই ঘটনা ঘটায়, স্কুলের বাকি পড়ুয়াদের অভিভাবকরাও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। একাধিক সরকারি এবং বেসরকারি বাসে ভাঙচুর চালানো হয়। চৌরাস্তা মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের প্রিজন ভ্যানে আঙুন লাগায় উত্তেজিত জনতা।
অবস্থা সামাল দিতে কলকাতা পুলিশের বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করতে হয়। কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষকর্তা সহ একাধিক পুলিশকর্মী জনতার ছোড়া ইঁটের আঘাতে আহত হন। পুলিশের বিরুদ্ধে পালটা লাঠিচার্জ এবং টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটানোর অভিযোগ ওঠে।
স্কুল চলাকালীন স্কুলের সামনে কীভাবে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটাতে পারে পুলিশ, উঠছে সেই প্রশ্নও।
পুলিশ সূত্রে খবর, ঘটনাস্থল থেকে মোট ১২জনকে গ্রেপ্তার করে ঠাকুরপুকুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধৃতদের মধ্যে কয়েকজন মহিলা এবং ২জন খাবার ডেলিভারি সংস্থার কর্মী রয়েছে।
সৌরনীলের পরিবারের অভিযোগ, দুর্ঘটনার প্রায় ৪৫ মিনিট পরে সৌরনীল এবং তার বাবাকে বিদ্যাসাগর হাসপাতালে আনা হয়। সেটাও হয়েছে স্কুলের শিক্ষকদের তৎপরতায়। দীর্ঘক্ষণ ধরে ছেলের দেহ আগলে ডায়মন্ড হারবার রোডে অসহায় অবস্থায় বসে ছিলেন সরোজ সরকার। তাঁর দুটি পা পিষে দিয়ে চলে গিয়েছে ঘাতক ট্রাকটি।
ঘটনাস্থল থেকে চম্পট দিলেও সাঁতরাগাছির কাছে ট্রাকটিকে পাকড়াও করে হাওড়া জেলা পুলিশ। যদিও প্রশ্ন, এতবড় কান্ড ঘটিয়ে প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটার পাড়ি দিল কিভাবে ট্রাক?
Comments :0