EDITORIAL

দুর্নীতিমালা

সম্পাদকীয় বিভাগ

স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন এবং বিরোধী দলগুলিকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে আক্রমণ করেছেন। লাল কেল্লায় ভাষণ দিতে আসার আগে সম্ভবত তিনি আয়নায় নিজের মুখটা ভাল করে দেখে আসেননি। দেখলে অবশ্যই তাঁর নজরে আসত তার মুখমণ্ডলে অজস্র দুর্নীতির ক্ষত দগদগ করছে। আর সেই ক্ষতগুলি বিরোধীদের তোলা অভিযোগের ক্ষত নয় একেবারে জাতীয় হিসাব নিরীক্ষক সিএজি চিহ্নিত ক্ষত। সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সময় ডামাডোলের  বাজারে চুপিসারে পেশ করা হয়েছিল সিএজি’র সেই রিপোর্টগুলি যেখানে বর্ণিত আছে মোদী জমানার গুরুতর ও ভয়ানক সব অনিয়ম, অর্থ নয়ছয় ও দুর্নীতির বিষয়গুলি। মোদীরা ভেবেছিলেন চালাকি করে নিজেদের দুর্নীতিগুলি আড়াল করে বিরোধীদের দুর্নীতিগ্রস্ত বলে আক্রমণ করে আগামী লোকসভা ভোটে বাজিমাত করবেন। মনে রাখা দরকার ক্ষণে ক্ষণে প্রসাধন মেখে ও পোশাক বদলে জনতার নজর টানা যায় কিন্তু খাতায় কলমে নথিবন্ধ হয়ে যাওয়া দুর্নীতি ঢাকা দেওয়া যায় না।


লোকসভার চলতি অধিবেশনে সিএজি-র যে রিপোর্ট পেশ হয়েছে তাতে অন্তত ৮টি অনিয়ম, অর্থ লোপাট তথা দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট ঘটনা আছে। এর মধ্যে চারটি সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের অধীনে। এছাড়া দুর্নীতি হয়েছে আয়ুষ্মান ভারত প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য প্রকল্পে, গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের পেনশন প্রকল্পে, স্বদেশ দর্শন প্রকল্পে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যাল-এ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী কথা বলেছেন তখন নিশানা করেছেন বিরোধীদের অথচ সচেতন ও সতর্কভাবে আড়াল করছেন নিজের দুর্নীতির কথা। তিনি যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সৎ হতেন তাহলে নিজের দুর্গন্ধ চাপা দিয়ে অন্যের দুর্গন্ধ খুঁজতে বেরোতেন না। ধোকাবাজি লুকিয়ে আছে এই জায়গাতেই।


সিএজি’র রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত মালা প্রকল্পে সড়ক নির্মাণে নির্ধারিত অপেক্ষা দ্বিগুণ থেকে ১৫ গুণ পর্যন্ত বর্ধিত ব্যয় দেখানো হয়েছে। তাতে অন্তত ১২ লক্ষ কোটি টাকার গরমিল হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। গুরুতর দুর্নীতি ধরা পড়েছে প্রধানমন্ত্রী জনআরোগ্য প্রকল্প। অস্তিত্বহীন একটি ফোন নম্বর দিয়ে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ রোগীর নাম নথিভুক্ত হয়েছে। তেমনি প্রায় এক লক্ষ মৃত ব্যক্তিকে চিকিৎসাধীন  রোগী দেখিয়ে তাদের চিকিৎসা বাবদ বিপুল টাকা সরানো হয়েছে। আবার চিকিৎসা হচ্ছে সেই সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেখানে পরিকাঠামোই নেই, এমনকি ডাক্তারও নেই। দুর্নীতি দেখা গেছে স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পেও। গ্রামীণ বৃদ্ধদের পেনশন প্রকল্প থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা সরিয়ে সরকারের সাফল্য প্রচারে বিজ্ঞাপন করা হয়েছে। অযোধ্যার উন্নয়নে অতিরিক্ত ২০ কোটি টাকা ঠিকাদারদের পাইয়ে দেওয়া হয়েছে।


স্মরণ করা যেতে পারে ইউপিএ জমানায় শেষ দিকে প্রধানত টুজি টেলিকম স্পেকট্রাম বণ্টন এবং কয়লাখনি বণ্টন নিয়ে অনিয়ম সংক্রান্ত সিএজি’র রিপোর্টকে হাতিয়ার করে এই মোদীরা দেশজু‍‌ড়ে শোরগোল তুলেছিলেন। বস্তুত সেই দুর্নীতির অভিযোগকে প্রধান ইস্যু করে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় এসে তৎকালীন সিএজি’র সেই প্রধানকে অবসরের পর গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করে পুরষ্কৃত করা হয়েছিল। পাশাপাশি সিএজি’র প্রধান পদে বসানো হয় গুজরাট থেকে তুলে আনা মোদীর একান্ত ঘনিষ্ট ও বিশ্বস্ত আমলাকে। সেই আমলা অনেক রেখে ঢেকে যে রিপোর্ট তৈরি করেছেন তাতেই যদি দুর্নীতির এহেন বহর ফুটে ওঠে তাহলে আদতে দুর্নীতি যে কতটা বিশাল ও ভয়ঙ্কর তা সহজেই অনুমেয়।
 

Comments :0

Login to leave a comment