‘‘ পৃথিবী জুড়ে ফুটবলের দর্শক সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু খেলাটার আকর্ষণ কমছে কারণ খেলাটা যেই কারণে মানুষের ভালো লাগত সেটাই ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। মূল বিষয় হল মানুষ যেটা দেখছেন সেটা উপভোগ্য কিনা। নইলে আসল লাভ হবে ফুটবল বাণিজ্যের। যত বেশি মানুষ খেলা দেখবেন, বাণিজ্য তত বেশি মুনাফা করবে। ফুটবল ভালো হল না বাজে তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু এই ট্রেন্ড যদি চলতে থাকে, উপভোগ্য খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমতে থাকে, খেলা বিরক্তিকর হয়ে যায়, তখন এই দর্শকের সংখ্যাও কমতে শুরু করবে।’’
বক্তা আর কেউ নন, উরুগুয়ের পুরুষ ফুটবল দলের ম্যানেজার মার্সেলো বিয়েলসা।
বিশ্ব ফুটবলে ইতিমধ্যেই একটি গুঞ্জন শুরু হয়েছে। একাংশের প্রাক্তন খেলোয়াড়, কোচ এবং ফুটবল প্রেমীদের বক্তব্য, চিরাচরিত আকর্ষণ হারাচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সুন্দর এই খেলাটি।
গত প্রায় ১৫ বছর ধরে ফুটবল বিশ্বকে মাতিয়ে রেখেছে লিওনেল মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। তাঁদের দুইজনের খেলা দেখতে ভালো লাগে তাঁদের নান্দনিক ক্রীড়াশৈলীর জন্য। মেসির প্রতিপক্ষকে ড্রিবল করা, কিংবা রোনাল্ডোর প্রায় মাঝমাঠ থেকে চকিতে নেওয়া গোলার মত শট দেখার জন্য এখনও রাত জাগেন ক্রীড়াপ্রেমীরা।
কিন্তু এই অংশের বক্তব্য, মেসি রোনাল্ডো পরবর্তী ফুটবল দুনিয়ায় তেমন ফুটবলার বাড়ন্ত। পরবর্তী প্রজন্মের ফুটবলারদের তৈরি করা হচ্ছে ‘ট্যাক্টিক্যাল’ ফুটবলের সঙ্গে মানানসই করে। সেখানে কেবলই ‘ট্রায়াঙ্গেল, পাসিং লেন এবং প্লেয়িং থ্রু দ্যা লাইন্সের’ আধিক্য। পায়ে বল ধরে রেখে ড্রিবল করার থেকে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সতীর্থকে পাস দেওয়া এবং দৌড়ে ফাঁকা জায়গা নেওয়া।
অনেকে বলছেন, ফুটবল এখন কেবলমাত্র পাস দেওয়ার খেলা তৈরি হয়েছে। এমনকি গোল করাও আসলে গোল কিপারকে এড়িয়ে জালে বল পাস করায় পরিণত হয়েছে।
এই আবহে মার্সেলো বিয়েলসার বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিয়েলসা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় স্তর ও ক্লাব ফুটবলে কোচিং করাচ্ছেন। আর্জেন্টিনা ও চিলির জাতীয় দলের প্রাক্তন এই কোচ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব লিডস ইউনাইটেড, ফ্রান্সের মার্সেই, লিলি, স্পেনের ক্লাবকে কোচিং করিয়েছেন।
অভিজ্ঞ এই কোচের মতে, ফুটবলকে খাঁচায় পুরে ফেলা হয়েছে। শৈশব থেকে পরবর্তী প্রজন্মের ফুটবলারদের নির্দিষ্ট একটি ছাঁচে ঢালার কাজ শুরু হয়। তারফলে তারা নিজস্বতা হারায়। এবং খেলোয়াড়দের সেই নিজস্বতার অভাবেই সমস্ত দলের খেলা একইরকম ঠেকতে শুরু করেছে।
কিন্তু এই সমস্যার শুরু কোথায়?
সমস্যাকে ২০২৩ সালে চিহ্নিত করেছিলেন লিওনেল মেসি। মজার ছলে। মুভিস্টার প্লাস কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বার্সেলোনায় নিজের প্রাক্তন কোচ পেপ গুয়ার্দিওলার সম্পর্কে মেসি বলেছিলেন, ‘‘ পেপ গুয়ার্দিওলা ফুটবলের যথেষ্ট ক্ষতি করেছেন। তাঁর কোচিং পদ্ধতি দেখতে এতটাই সরল, যে সবাই সেটাই নকল করতে শুরু করেছে।’’
এবং সেই নকল করার ফলেই সেন্টার ব্যাকরা ব্যাক লাইন থেকে খেলছেন, কিংবা ফুলব্যাকরা মাঝমাঠে নেমে আসছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজস্ব শৈলী তৈরি করে গুয়ার্দিওলা কোনও ভুল করেননি। করেননি বলেই ৩৮টি ট্রফি জিতে ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সফল কোচের তকমা তাঁর বুক পকেটে। কিন্তু তাঁর এই সাফল্যের ফলে সবাই চোখ কান বন্ধ করে গুয়ার্দিওলা হতে চায়। খেলোয়াড়দের উপর এই সিস্টেম চাপিয়ে দিতে চায়, এবং তারফলেই খেলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে খেলোয়াড়দের নিজস্ব উদ্দামতা, ছকের বাইরে বেরিয়ে কোনও কিছু করতে ভয় পাচ্ছেন খেলোয়াড়রা, কারণ অন্যরকম ফল হলে খেলোয়াড়ি জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু বিকল্প কি একেবারেই নেই? রয়েছে। জুর্গেন ক্লপের কোচিংয়ে লিভারপুল ফুটবলে বিকল্প দর্শন উপহার দিয়েছিল। সেই খেলায় ট্রায়াঙ্গেল, ব্যাকপাস এবং দ্রুতগামী পাসিং ফুটবল থাকলেও, তারসঙ্গেই একাধিক ফুটবলারকে স্বাভাবিক নান্দনিক ফুটবল খেলার ছাড়পত্র দিয়েছিলেন ক্লপ। দলের শেপ ভেঙে যাওয়ার ভয়ে পিছিয়ে আসেননি।
তারফলে ফুটবলও ছিল আকর্ষণীয়।
ফুটবল বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বর্তমানে সেই ধাঁচের ফুটবল দেখাই যায় না। ঘুম পাড়ানি সতর্ক ফুটবল হয়ে চলেছে চারিদিক। কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর ফুটবল। প্রতিপক্ষের ফাঁকা জায়গা ব্যবহার করে বল জালে ঠেলা।
এই অংশের বক্তব্য, চলতি ইউরো কাপে দল হিসেবে এগিয়ে ছিল ফ্রান্স, পর্তুগাল এবং ইংল্যান্ড। তিনটি দলেই এমন বহু ফুটবলার রয়েছেন, যাঁদের ব্যক্তিগত দক্ষতা অসামান্য। কিন্তু এই তিন দলেরই ম্যানেজারদের ফুটবল দর্শনে ভিন্নতা না থাকার কারণে ৩টি দলই ইউরোর ফেভারিট নয়।
অপরদিকে স্পেন এগিয়ে রয়েছে ঠিক এই কারণে। ‘আধুনিক’ ফুটবলের যাবতীয় কৌশলের পাশাপাশি লামিনে ইয়ামাল, নিকো উইলিয়ামসের মত ফুটবলারদের ব্যক্তিগত নৈপুন্যের পায়ে বেড়ি পড়ায়নি স্প্যানিশ সিস্টেম। তারফলে কার্যকরী ফুটবলের পাশাপাশি উপভোগ্য ফুটবলেরও স্বাদ পাচ্ছেন ফুটবল প্রেমীরা।
Comments :0