Hindutva effect on cinema

হিন্দুত্বের অন্ধতার গ্রাসে সিনেমা

সম্পাদকীয় বিভাগ

গোয়ার আন্তর্জাতিক উৎসব প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে ‘কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি অন্তর্ভুক্ত করাকে মেনে‍ নিতে পারেনি জুড়ি বোর্ডের প্রধান ইজরায়েলি পরিচালক  নাদাভ লাপিড। এমন একটি নিম্নমানের প্রচারধর্মী সিনেমাকে এমন এক  মর্যাদাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে হাজির করা শুধু উৎসবের মর্যাদাহানি নয়, এটা ভারতেরও সন্মানহানি। ভারতে নির্মিত সিনেমা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে এতকাল ধরে দর্শকদের হৃদয়কে ‍ যেভাবে আন্দোলিত করেছে, সেখানে এই সিনেমা কলঙ্ক রেখে এঁকে দিয়েছে। এই সিনেমা সকলকে হতাশ ও বিস্মিত করেছে।  লাপিড কোনও রাখঢাক না রেখেই স্পষ্টভাবে কাশ্মীর ফাইলস-র গুণমান নিয়ে প্রশ্ন  তুলেছেন। বলেছেন সিনেমাটি কুরিচিপূর্ণ, প্রচারধর্মী ও হিংসায় ভরা। আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিযোগিতায় নামাতে হলে যে-কোনও সিনেমাকেই একটা ন্যূনতম গুণগতমান উত্তীর্ণ হতে হয়। কাশ্মীর ফাইলস সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। মূলত শাসকদলের রাজনৈতিক চাপেই সিনেমাটিকে প্রতিযোগিতাতে রাখা হয়েছে। এই ঘটনা থেকে আর একবার প্রমাণ হয়ে গেল আরএসএস-বিজেপি জমানায় বিজ্ঞান কংগ্রেসকে যেমন অবৈজ্ঞানিক যুক্তিহীন পৌরাণিক কল্পকাহিনিতে ভরিয়ে তোলা হয়,  তেমনি চলচ্চিত্র উৎসবকেও হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। বিজ্ঞান কংগ্রেস থেকে যেমন বিজ্ঞানকে নির্বাসন দিয়ে কুসংস্কার ও পুরাণকে বিজ্ঞান বলে চালানো হচ্ছে। ইতিহাস গবেষণা থেকে যুক্তি ও প্রমাণকে নির্বাসন দিয়ে অনৈতিকহাসিক কল্পিত কাহিনি  বলে হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসের  পুনর্নিমাণ হচ্ছে, তেমনি চলচ্চিত্র উৎসবেও‍ শিল্প-সুষমামণ্ডিত উন্নত জীবনবোধকে সরিয়ে রাজনৈতিক পোপাগান্ডাকে স্থান করে দেওয়া  হচ্ছে। কাশ্মীর ফাইলস-র মতো সিনেমায় ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্থান পাওয়া তারই ন্যক্কারজনক উদাহরণ।


কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জীবন-যন্ত্রণাকে অবলম্বন করে সিনেমা তৈরি হলেও কাশ্মীরের জনগণের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া, উপত্যকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার নিয়ন্ত্রণ, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ এমনকি স্বাধীনভাবে চলার, মতপ্রকাশ করার ও সমালোচনা করার অধিকার কেড়ে দমনমূলক কেন্দ্রীয় শাসন কায়েম করাকে আড়াল করা ছিল মূল উদ্দেশ্য। দেশজুড়ে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়িয়ে কাশ্মীরকে একপেশি ও বিকৃতভাবে দেখিয়ে বিভাজনের রাজনীতিকে পোক্ত করতেই তৈরি হয়েছে এই ছবি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এটির মান নিম্নমুখী।


দেশে প্রতিবছর শত শত সিনেমা তৈরি হয়। কোনও সিনেমা নিয়ে বিজেপি ও হিন্দুত্বাবদী নেতারা মাতামাতি করেনি। কিন্তু কাশ্মীর ফাইলস নিয়ে গোটা সঙ্ঘ পরিবারই  যেন রাস্তায় নেমে পড়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয়মন্ত্রী  ও দলীয় নেতারা সিনেমার প্রচারে নেমে পড়েছিলেন। সংবাদমাধ্যম এবং সোশাল মিডিয়ায় প্রচারের ঝড় তোলা হয়েছে। আসলে বিজে‍‌পি’র কাশ্মীর নীতির পক্ষে  এই সিনেমাকে হাতিয়ার করে তোলা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে লাপিডের সমালোচনা হিন্দুত্ববাদী নেতাদের হজম হয়নি। তারা হই হই করে নেমে পড়েছে লাপিডের বিরুদ্ধে। লাপিডকে আক্রমণ করতে গিয়ে তারা যেসব যুক্তি হাজির করছে, সেগুলি শুধু অপ্রাসঙ্গিকই নয়, ছেলেমানুষিও বটে। বলা হচ্ছে, লাপিড কাশ্মীরের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানেন না।


মনে রাখা দরকার, কোনও সিনেমার গুণগত মান, শিল্প, উৎকর্ষ যাচাই করতে বাস্তবে কোথায় কি হচ্ছে, তার বিশেষজ্ঞ হবার দরকার নেই। তাছাড়া এটা তথ্যচিত্র নয় বা ক্ষেত্র সমীক্ষার ভিডিও রেকর্ডিং নয়। হিন্দুত্ববাদী হতে গেলে যে সিনেমার গুণগত মান যাচাইয়ের শর্তগুলি সম্পর্কেও নির্বোধ হতে হয়, তা বিস্ময়ের। লাপিড কাশ্মীরের অবস্থা পণ্ডিতদের অবস্থা নিয়ে কথা বলেননি। বলেছেন ছবির মোটা দাগের উদ্দেশ্য নিয়ে। অযোগ্য হতে খারাপ বা নিম্নমানের ছবি হতেই পারে। কিন্তু তাইবলে কারসাজি করে নিষ্ঠুর  ও হিংসাত্মক ছবি!
 

Comments :0

Login to leave a comment