Mamata Banarjee

নিরাপদ নয়, রাতে মেয়েদের বেরোতে বারণ করলেন মুখ্যমন্ত্রী

রাজ্য

রাতে মেয়েদের বাইরে না বেরনোর পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। দুর্গাপুরে একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রীকে একাধিক দুষ্কৃতী ধর্ষণ করে শুক্রবার। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার নিজেকে ‘স্তম্ভিত’, ‘হতবাক’ দাবি করা মুখ্যমন্ত্রী এই পরামর্শ দিয়েছেন।
তাঁর এই পরামর্শ ক্ষুব্ধ, বিরক্ত করেছে রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মানুষকে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মেয়েরা আরও নিরাপত্তার অভাব বোধ করবেন এবং দুষ্কৃতীরা অপরাধের একটি অজুহাত পাবে বলেই আশঙ্কা করছেন তাঁরা। প্রশ্ন উঠেছে, রাত কী তবে দুষ্কৃতীদের জন্য ছেড়ে রাখার পক্ষে ওকালতি করলেন মুখ্যমন্ত্রী? তাঁর শাসনে রাতের পশ্চিমবঙ্গ আদৌ নিরাপদ নয় বুঝিয়ে দিলেন মমতা ব্যানার্জিই? প্রসঙ্গত, আর জি কর হাসাপাতালের মধ্যে এক ট্রেনি চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পর রাজ্য সরকার মহিলাদের নাইট ডিউটি সংক্রান্ত একটি নির্দেশিকা জারি করেছিল, যা থেকে এই ধারণা মমতা ব্যানার্জির সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল যে, মহিলাদের রাতের ডিউটি ধর্ষণের কারণ।
রবিবার মুখ্যমন্ত্রী আলিপুরদুয়ারে যাওয়ার আগে দমদম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন। সাংবাদিকরা দুর্গাপুরে ওই ধর্ষণের ঘটনার বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন। মমতা ব্যানার্জি সেই প্রসঙ্গে বলেন,‘‘স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো ঘটনা। ওই মেয়েটি একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়ছিল। বেসরকারি কলেজে...কার দায়িত্ব। রাত সাড়ে ১২টায় বেরলো কী করে? আমি যতদূর জানি জঙ্গলের মধ্যে ঘটেছে ঘটনাটি। তদন্ত চলছে। আমি হতবাক। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিকে সতর্ক হতে হবে। পড়ুয়াদের টেক কেয়ার(দেখভাল) করতে হবে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে রাতের বেলা বেরোতে দেওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে ছোট মেয়েদের। নিজেদের রক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে জঙ্গল এলাকায়।’’
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য এবং বাস্তবতায় ফারাক আছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ঘটনা রাত সাড়ে ১২টার। কিন্তু পুলিশের তদন্ত বলছে ওই ছাত্রী কলেজ ক্যাম্পাস থেকে তাঁর এক সহপাঠীর সঙ্গে রাতের খাবারের জন্য বেরিয়েছিল রাত ৭টা ৫৮মিনিটে। তিনি ফিরে আসেন রাত ৯টা ২৯ মিনিটে। ওই মেডিক্যাল কলেজের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পুলিশ এই তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে রাত ‘সাড়ে ১২টায় বেরনো’ কোথায় পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী? ঘটনার সময় সম্পর্কে তাঁর এই মন্তব্য তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে বলে পুলিশের আধিকারিকদের একাংশও মনে করছেন। 
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন,‘জঙ্গলের মধ্যে ঘটনা ঘটেছে।’ প্রশ্ন উঠেছে, জঙ্গলের মধ্যে অপরাধের দায়িত্ব কী পুলিশের নয়? প্রশ্ন উঠেছে, মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। যদিও পুলিশের তদন্ত বলছে, যে জায়গা থেকে ওই ছাত্রীকে টেনেহিঁচড়ে দুষ্কৃতীরা নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে সন্ধ্যা নামলেই নেশাড়ুদের দেখা যায়। প্রকাশ্যে মদ্যপান, নেশা করে একদল যুবক। পুলিশ সক্রিয় থাকলে ওই জায়গায় দুর্বৃত্তরা এত বেপরোয়া হতে পারত না। 
মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ার যে অংশ সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে করেছেন অনেকে তা হলো, ‘বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে রাতের বেলা বেরোতে দেওয়া উচিত নয়। নিজেদের রক্ষা করতে হবে।’ এই প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ মালিনী ভট্টাচার্য এদিন বলেছেন,‘‘মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ, সরকার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাইছে। যে দোষ অপরাধীদের, তা চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে নির্যাতিতার উপর। আর জি কর হাসপাতালের নৃশংস ঘটনার পরেও রাতে মেয়েদের ডিউটি সংক্রান্ত এমন একটি নির্দেশিকা সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা হয়েছিল। আমরা তার তীব্র নিন্দা করেছিলাম।’’ ভট্টাচার্য আরও বলেন,‘‘মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের পরে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। যেখানে এক ছাত্রীকে ক্যাম্পাসের ভিতরে তথাকথিত কয়েকজন সনাতনী ধর্ষণের পরে সেখানকার প্রশাসন, সরকার প্রশ্ন তুলেছিল যে, কেন ওই ছাত্র রাতে ক্যাম্পাসে ঘুরছিল। মহিলাদের গতিবিধি একটি লক্ষ্মণরেখায় বেঁধে দেওয়ার এই চেষ্টার নিন্দা করি। এতে মেয়েদের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব বাড়বে। নজর অপরাধীদের থেকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে নির্যাতিতার দিকে।’’২০১৩-এর ১নভেম্বর ওই উপর্যুপরি ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছিল, যে ঘটনায় অভিযুক্ত তিনজন ছিল হিন্দুত্ববাদী প্রচারক, বিজেপি’র কর্মী।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ বছরে বিভিন্ন ধর্ষণের ঘটনায় মমতা ব্যানার্জি এমন নানা মন্তব্য করে অপরাধকে লঘু করার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ। যেমন ২০১২-র ২৫ফেব্রুয়ারি কাটোয়ায় চলন্ত ট্রেনে কিশোরী মেয়ের সামনে এক মহিলাকে ধর্ষণের ঘটনাকে ’ছোট ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। যদিও সেই ঘটনায় বীরভূমের লাভপুর থেকে দুই শাসক দলের কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছিল। ২০২২-এর এপ্রিলে হাঁসখালিতে ধর্ষিতা হয়েছিলেন এক কিশোরী। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়। ১২ এপ্রিল সেই প্রসঙ্গে মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন,‘‘আপনি রেপ বলবেন, না কি প্রেগনেন্ট বলবেন, না কি লাভ অ্যাফেয়ার বলবেন...না কি শরীরটা খারাপ ছিল, না কি কেউ ধরে মেরেছে...আমি পুলিশকে বলেছি, ঘটনাটা কী? মেয়েটার নাকি লাভ অ্যাফেয়ার ছিল বলে শুনেছি।’’ এই ঘটনাতেও তৃণমূলের এক পঞ্চায়েত সদস্যর ছেলে অভিযুক্ত ছিল।
এমন আরও মন্তব্য ‌করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। দুর্গাপুরের ঘটনাতেও দুষ্কৃতীরা তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের ছাতার নিচে আছে বলেই স্থানীয়দের অনেকের অভিযোগ।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে একাধিক জন ওডিশার বাসিন্দা ওই ছাত্রীকে সেদিন ধর্ষণ করেছিল। পুলিশ ৩জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ওই ছাত্রী যে সহপাঠীর সঙ্গে সেদিন বেরিয়েছিল, তাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। সেই সহপাঠী সেদিন ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে এসেছিল। পুলিশ জানতে পেরেছে সেদিন রাত ৮টা ৪২ মিনিটে ওই সহপাঠী একাই ফিরেছিলেন ক্যাম্পাসে। কিছুক্ষণ পায়চারি করে তিনি আবার ৮টা ৪৮ মিনিটে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যান। রাত ৯টা ২৯ মিনিটে সেই সহপাঠীর সঙ্গে ধর্ষিতা ফিরে আসেন ক্যাম্পাসে। ৯টা ৩১ মিনিটে নির্যাতিতা ছাত্রী হস্টেলে চলে যান। তারপর তাঁর অন্য সহপাঠীদের তিনি ঘটনাটি জানান। পুলিশ এই ঘটনায় আরও ২জনকে খুঁজছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment