অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রবল ঘূর্ণিঝড়কে খাঁচাবন্দি হওয়ায় এবার শেষ হাসিটি হাসলো সেই আবহবিজ্ঞান। ঘূর্ণিঝড় হানার ছয় দিন আগে ১৮ অক্টোবর ‘দানা’ আছড়ে পড়ার কথা জানিয়েছিল একটি বেসরকারি আবহাওয়া সংস্থা। আবহাওয়া বিজ্ঞানের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং আমেরিকান মডেলের গাণিতিক হিসাবে দিনক্ষণও হুবহু মিলে যায়।
ওই পূর্বাভাসের দুই দিন পর ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কার কথা জানায়। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা এবারের ঘূর্ণিঝড়ে কোনও হতাহতের ঘটনা নেই। ওডিশা সরকার সেকথা ঘোষণাও করেছে। পঁচিশ বছর পর সুপার সাইক্লোনে ‘জিরো ক্যাজুয়াল্টি মিশন’ ছুঁয়ে ফেললো মানুষের সচেতনা। ১৯৯৯ সালে যেখানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় প্রায় ১০ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়েছিল, সেখানে এবারে ১জনের মৃত্যু না হওয়াটা একটা বড় জয়।
একসময়ে তো ওডিশা আর ঘূর্ণিঝড় সমার্থক হয়ে গেছিল। ফণী, বুলবুল, আমফানের পর ফের দানা। গত ২৫ বছর ধরে ঝড়কে সইতে থাকা সাহসী উৎকলবাসী রুখে দিলেন ভয়বহতা। ১৯৯৯ সালে ওডিশার বুকে ‘সুপার সাইক্লোন’ আছড়ে পড়ার ঘটনা অতীত হলেও সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি ভোলার না। ওই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে গ্রামকে গ্রাম গ্রাম তছনছ হয়ে যায়।
২৯ অক্টোবর জগৎসিংহপুর জেলার পারাদ্বীপে আছড়ে পড়েছিল ওই প্রবল সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা ধরে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল সেই ঘূর্ণিঝড়। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অকল্পনীয়। ঘণ্টায় ২৬৭ কিলোমিটার ঝোড়ো হাওয়ার জেরে হাজার হাজার প্রাণ যায়।
সুপার সাইক্লোনের তাণ্ডবে সমুদ্রের জল গ্রাম থেকে মানুষজনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল। ভয়ঙ্কর ছিল সেই অভিঘাত। জগৎসিংহপুর জেলাতে মৃত্যু হয়েছিল ৮,১১৯ জনের। এরপর সেই সুপার সাইক্লোনে কটকে ৪৭১ ও কেন্দ্রাপাড়ায় ৪৬৯ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছিল।
১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোনের পর থেকে ওডিশা এ যাবৎ ১২টি ঘূর্ণিঝড় দেখেছে। ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর ওডিশায় আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় ‘ফাইলিন’। সেই ঝড়ে ঘরবাড়ি, চাষের জমি, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল। বিশেষ করে গঞ্জাম, পুরী এবং খুর্দা জেলায় মারাত্মক তাণ্ডব চালিয়েছিল ‘ফাইলিন’। গঞ্জাম জেলার গোপালপুরের কাছে ২৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় ‘ফাইলিন’।
২০১৪ সালে ওডিশায় যে ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব চালিয়েছিল তার নাম ছিল ‘হুদহুদ’। সে বছরের ১২ অক্টোবর বিশাখাপত্তনমের পূর্ব উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড়টি। ওডিশার গজপতি, কোরাপুট, নবরংপুর এবং মালকানগিরিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল হুদহুদের প্রকোপে। ওই সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ছিল ১৮৫ কিলোমিটার। ২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ওডিশায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘দায়’-এ। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ওডিশার গোপালপুরে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছিল মালকানগিরি জেলা।
ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ার সময়ের ঝড়ের গতি ছিল ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার। ওই বছরে ঠিক পরের মাসে অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় ‘তিতলি’ অন্ধ্র প্রদেশের পালাসায় আছড়ে পড়ে। যার প্রভাব পড়েছিল ওডিশার গোপালপুরে। গঞ্জাম ও গজপতি জেলাতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঝোড়ো হাওয়ার গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় প্রায় ১১০ কিলোমিটার।
২০১৯ সালের ৩ মে ওডিশার পুরীর কাছে আছড়ে পড়ে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’। ঘণ্টায় ২০৫ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়ে ওই ঘূর্ণিঝড়। তছনছ করে দেয় দেশের অন্যতম পর্যটন শহর পুরীকে। ওই ঘূর্ণিঝড়ে তাণ্ডবে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ওই বছরে ৯ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগরদ্বীপে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’।
বাংলায় স্থলপতন হলেও ‘বুলবুল’-এর প্রভাবে ওডিশার বালেশ্বর জগৎসিংহপুর, কেন্দ্রাপাড়া এবং ভদ্রকের বিভিন্ন অংশে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল। ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়েছিল ‘বুলবুল’।
২০২০ সালের ২০ মে পশ্চিমবঙ্গের দীঘা এবং হাতিয়ার মধ্যে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’। এর প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ওডিশার বালেশ্বর, ভদ্রক, জগৎসিংহপুর এবং কেন্দ্রাপাড়ার মতো উপকূলীয় জেলাগুলিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। হাজার হাজার গাছ উপড়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়টি আছড়ে পড়ার সময় বাতাসের গতিবেগ পড়ার সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার।
এরই পরের বছর ২০১২ সালে ফের ওডিশার ভিতরকণিকা জাতীয় উদ্যানের কাছে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’। ২৬ মে ধেয়ে আসা ওই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার। ইয়াস ক্ষয়ক্ষতি ঘটনায় ব্যাপক।
এরপরে কিছুদিন ভালোই ছিল ওডিশা উপকূলের মানুষজন। ফের ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘গুলাব’-এর ক্ষতি সইতে হয়। সেবছর ঘূর্ণিঝড় ‘গুলাব’ ওডিশার প্রতিবেশী অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীকাকুলাম জেলায় আছড়ে পড়লেও মারাত্মক পরোক্ষ ক্ষতি হয় ওডিশাতে।
অন্ধ্রে আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় ‘গুলাব’ ওডিশাতে ভালো ঝড়-বৃষ্টি ঘটায়। ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে চলে ওডিশা উপকূলে। অপেক্ষাকৃত গতিবেগ কম থাকায় সে যাত্রায় ওডিশা বড় ক্ষয়-ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
এরপরে ফের অন্ধ্র প্রদেশের আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েছিল ওডিশায়। গভীর নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত ২০২২ সালের ওই ঘূর্ণিঝড়টির নাম ‘অশনি’। অন্ধ্র প্রদেশের মছলিপত্তনম এবং নরসাপুরমের মাঝে সেটি আছড়ে পড়ে ১১ মে। অন্ধ্র প্রদেশের পড়লেও তার প্রভাব পড়েছিল ওডিশাতে। ঝোড়ো হাওয়ার গতি পৌঁছে গেছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। তছনছ হয়েছিল উৎকল উপকূল।
এরপরে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র দেখা মিললো। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ দানা’র সামনের অংশ স্থলভাগ স্পর্শ করে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র বা ‘সাইক্লোন আই’ প্রবেশ করতে লাগে দু’ঘণ্টা। রাত দেড়টা থেকে ভোর সাড়ে তিনটে পর্যন্ত। শেষে ঘূর্ণিঝড়ের লেজের অংশ ডাঙায় ঢুকে পড়ে শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটায়। শেষ হয় স্থলভাগে প্রবেশের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া (ল্যান্ডফল)।
তীব্র ঘূর্ণিঝড় থাকাকালীন ‘দানা’র গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় গতিবেগ ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। স্থলভাগে ঢোকার পর সর্বোচ্চ গতি দাঁড়ায় ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। শুক্রবার দুপুরের আড়াইটা নাগাদ ভদ্রকের উত্তর-পশ্চিমে ৪০ কিলোমিটার ধেয়ে শক্তি খুঁইয়ে পরিণত হয় গভীর নিম্নচাপে। এরপর দক্ষিণে গিয়ে ‘দানা’ দাঁড়িয়ে থাকে নিম্নচাপ হয়ে।
Comments :0