সরকারি জমিকে খোলাবাজারে বিক্রির ছাড়পত্র দিয়ে দিল নবান্ন।
বুধবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের হাতে থাকা জমি এবার বাজারে বিক্রি করতে আর কোনও অসুবিধা থাকল না। নবান্ন সূত্রের খবর, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের হাতে এই মুহূর্তে প্রায় ২০ হাজার একর জমি আছে। এবার সেই জমিকে লিজ হোল্ড থেকে ফ্রি হোল্ড করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য মন্ত্রিসভা। যার অর্থ একটাই, সরকারের এই সিদ্ধান্ত জমি হাঙরদের কাছে খোলা তরবারির মতো। রাজ্যের যে কোনও সরকারি দপ্তরের জমি এখন থেকে বিক্রি করতে সরকারের আরও কোনওই অসুবিধা থাকল না।
স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন পরিকাঠামোর জন্য রাজ্যের বিভিন্ন জেলাতে সরকার জমি অধিগ্রহণ করেছিল। বিভিন্ন দপ্তরের হাতে এতদিন ছিল সেই বিপুল জমি। সরকারের হাতে থাকা অব্যবহৃত সেই জমি এখন চলে যাবে জমি মাফিয়াদের কাছে। পাট্টার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে চলেছেন লক্ষ লক্ষ ভূমিহীন রাজ্যবাসী।
তথাকথিত জমি আন্দোলনকে সামনে রেখে ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। আর তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে খসে পড়ল জমি আন্দোলনের নেত্রীর আসল চরিত্র। নবান্নের এক শীর্ষ আধিকারিকের বক্তব্য,‘‘ লিজ হোল্ড থেকে সরকারি জমি ফ্রি হোল্ডে তুলে দেওয়া কার্যত এক চরম নীতিগত সিদ্ধান্ত। মন্ত্রিসভার এদিনের অনুমোদনের পর আর সরকারি জমি বিক্রি করতে কোনও বাধাই থাকল।’’
সূত্রের খবর, সরকারের হাতে বিভিন্ন দপ্তরের হাতে ২০হাজার একরের ওপর জমির পাশাপাশি খাস জমিও আছে। সেই খাস জমির পরিমাণ প্রায় আড়াই লক্ষ একর। আপাতত খাস জমিতে হাত পড়বে না বলে জানা গেছে। কিন্তু খাস জমিকে সরকার দপ্তরের হাতে তুলে দিয়ে বিক্রি করার অসুবিধা থাকবে না। এর ফলে রাজ্যের গরিব মানুষের পাট্টা পাওয়ার কাজও ভবিষ্যতে থাকার পথ বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। চার দশক আগে ভূমিহীনদের হাতে জমি তুলে দিয়ে গোটা দেশে নজির তৈরি করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। এখন সেই রাজ্যেই জমি আন্দোলনকে সামনে রেখে ক্ষমতায় আসার পর দেদার সরকারি জমি বিক্রি করার পথে বর্তমান মা মাটি মানুষের সরকার।
এদিন মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে নীতিগতভাবে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও সরকারের তরফে না কোনও মন্ত্রী কিংবা কোনও আধিকারিক সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি। সরকারি সম্পদ বিক্রি করার সিদ্ধান্ত সিলমোহর দিয়ে মমতা ব্যানার্জি চলে যান আউট্রাম ঘাটে। গঙ্গাসাগর মেলার আয়োজন নিয়ে সরকারি কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে কীভাবে গঙ্গায় আরতির ব্যবস্থা হবে তা নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা জানান।
এতদিন সরকারি জমিকে লিজে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু ছিল। লিজের জমির মালিকানা সরকারের হাতেই থাকত। যে সংস্থা বা ব্যক্তি সরকারি জমি লিজ পেত, তাকে জমির মূল্যের ওপর সেলামি ধার্য করা হতো। একইসঙ্গে ফি বছর লিজের পুনর্নবীকরণ জন্য একটা টাকা লিজ হোল্ডারকে সরকারের কাছে জমা করতে হতো। সাধারণভাবে ৩০ বছরের জন্য স্বল্পমেয়াদি লিজ ও ৯৯ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লিজ দেওয়া হতো। এবার সেই লিজের ব্যবস্থাই তুলে দিয়ে সরকারি জমিকে ফ্রি হোল্ড করে দিয়ে বিক্রি করার পথ খুলে দেওয়া হচ্ছে।
আর্থিকভাবে রাজ্যকে পঙ্গু করে দিয়ে এখন আয় বাড়াতে সরকারি সম্পদকে ঘটি-বাটি বিক্রি করার জায়গায় এনে ফেলেছে। প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা গেছে, সরকারের আয় কীভাবে বাড়ানো যায় তার জন্য প্রতিটি দপ্তরকে পরিকল্পনা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ভূমি দপ্তর মমতা ব্যানার্জির হাতে। তাই জমি বিক্রি করে কীভাবে আয় বাড়ানো যায় তার পরিকল্পনা করার জন্য নিজেই উদ্যোগী হন মুখ্যমন্ত্রী। জমি লিজ দিয়ে সরকারের কোষাগারে বেশি টাকা আসে না। বরং সেই জমিকে সামনে রেখে ব্যবসা করে লিজ হোল্ডাররা প্রচুর মুনাফা করে। তাই লিজ হোল্ড জমি থেকে আয় বাড়ানোর জন্য পথ খুঁজতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। ভূমি দপ্তরের এক আধিকারিকের বক্তব্য,‘‘ লিজ দিয়ে যে সরকার জমির মূল্যের ৯৫শতাংশ টাকা সেলামি বাবদ তুলে নেয়। তাই সেখানে আর বাড়তি আয়ের সুযোগ নেই। তাই লিজ না দিয়ে ফ্রি হোল্ড করে দিয়ে সরকারের কোষাগারে টাকা আসবে।’’
মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তের ফলে সেচ দপ্তর, পূর্ত দপ্তর, স্কুল শিক্ষা দপ্তর, বন দপ্তর, পঞ্চায়েত ও পৌর দপ্তরের হাতে থাকা বিপুল জমি এখন বিক্রি করার পথ খুলে দেওয়া হলো। চা বাগানের জমি সরকার লিজে দেওয়া। এবার সেই জমিও বাগান মালিকদের কাছে বিক্রি করার ছাড়পত্র দিয়ে রাখল নবান্ন।
ইতিমধ্যেই এরাজ্যে শাসকদলের নেতাদের সহায়তায় ইতিমধ্যে বহু জমি জমি হাঙরদের কাছে চলে গেছে। খাস জমি থেকে শুরু করে পৌরসভা ও জেলা পরিষদের অধীনে থাকা জমি বেহাত হয়ে চলে গেছে জমি মাফিয়াদের কাছে। বড় রাস্তার ধারে পূর্ত দপ্তরের জমি, নদীর পাড়ে সেচ দপ্তরের জমি বেহাত হয়ে গেছে। এবার সেই অবৈধ জমি হাতানো মালিকদের বৈধতা মিলবে মন্ত্রিসভার এদিনের সিদ্ধান্তে।
Comments :0