দীপ্তজিৎ দাস
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক টালমাটাল অধ্যায় ১৯২০-এর দশক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ শাসকের নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তরোত্তর, প্রতিকারের দিশা খুঁজছে একটা জাতি। অসহযোগ আন্দোলনের হঠাৎ পরিসমাপ্তি হতাশায় আচ্ছাদিত করেছে দেশের যুবসমাজকে। সেই চঞ্চল সময় দেশের রাজনীতিতে ক্রমশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে কমিউনিস্টদের আনা পূর্ণ স্বরাজের দাবি, নেতৃত্বের গুণে জাতীয় কংগ্রেসে উদয় হচ্ছে সুভাষচন্দ্র এবং জওহরলালের মত তরুণ নেতৃত্বের, সূর্য সেনের নেতৃত্বে বাংলার মাটিতে একদল বেপরোয়া ছাত্র যুব স্বপ্ন দেখাচ্ছে নতুন ভোরের। সেই উত্তাল সময়ে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির আন্দোলনে আবির্ভাব হয় ভগৎ সিং নামক এক ঝড়ের পাখির।
ভগৎ সিং আজ সময়ের কাঁটাতার পেরিয়ে প্রাসঙ্গিক সর্বত্র। নিখাদ দেশপ্রেম ,বিদ্রোহ, বিপ্লব, আত্মত্যাগের মূর্ত প্রতীক তিনি। করাচি থেকে কালিকট, মাত্র ২৩ বছরের এক দুঃসাহসিক জীবন প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে আইকন। এই সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছে ভগৎ সিংয়ের ঐতিহ্যকে, তার রাজনৈতিক চিন্তার কথা অনুভব না করেই। বিজেপি থেকে আম আদমি পার্টি, জাতীয় কংগ্রেস অথবা আকালি দল বিভিন্ন সময়ে ভোট বৈতরণী পার করতে চেয়েছে ভগৎ সিংয়ের সাথে নিজের সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার ব্যর্থ প্রচেষ্টায়। কিন্তু কেবল সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের মধ্যেই ভগৎ সিংকে বদ্ধ করে রাখা তাঁর প্রতিভার অবমূল্যায়ন। স্বাধীন ভারত গঠনের জন্য সমাজতন্ত্র কেন্দ্রিক যে সুস্পষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তিনি তা ছিল সেই সময়ের সাপেক্ষে অনেকটাই এগিয়ে থাকা।
১৯০৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পাঞ্জাবের লায়ালপুর জেলায় জন্ম এই বিদ্রোহীর। গদর বিপ্লবীদের সংগ্রাম পাঞ্জাবে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ব্রিটিশ সরকার বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে প্রথম লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় কর্তার সিং সারাভা নামক এক উনিশ বছর বয়সি বিপ্লবীকে প্রাণদণ্ড দেয়। পরবর্তীকালে তিনিই হয়ে ওঠেন ভগৎ সিংয়ের জীবনের আদর্শ। ফাঁসির প্রাক্কালে এক চিঠিতে ভগৎ সিং লেখেন,‘আমার রক্তের সম্পর্কে আত্মীয়তা শহীদ ক্ষুদিরাম বসু আর কর্তার সিং সারাভার সঙ্গে। আমাদের সকলের রক্তের চরিত্র একরকম।’ ১৯১৯ সালে ঘটে যাওয়া নৃশংস জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। ব্রিটিশের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও স্বাধীনতার অকৃত্রিম স্পৃহা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে তাঁর মধ্যে। নবম শ্রেণি পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন লাহোর ন্যাশনাল কলেজে। লাহোরে সেই সময় এই কলেজ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের আঁতুড় ঘর। ১৯২৩ সালে তিনি এবং যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উত্তরপ্রদেশে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন। হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের কার্যাবলী দেশের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাধীনতা সম্পর্কিত নতুন আশার সঞ্চার করে। কিন্তু কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা এই সংগঠনের গতিপথে হঠাৎই যেন এক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকুল্লাহ খান, রাজেন লাহিড়ি, রোশান সিংহের ফাঁসি এবং সংগঠনের প্রায় প্রথম সারির সমস্ত নেতৃত্বের কারাদণ্ড অথবা দ্বীপান্তর এক নেতৃত্ব সঙ্কটের জন্ম দেয়। এই সঙ্কটকালেই নিজেদের প্রতিভাত করেন ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদরা। ভগৎ সিং অনুভব করলেন দেশমুক্তির সঠিক পথ খুঁজতে গেলে সঠিক রাজনৈতিক তত্ত্বকে অবলম্বন করতে হবে। তাই সংগ্রামের পাশাপাশি পঠনও সমান গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে যেমন প্রয়োজন অস্ত্রের তার সাথে সাথেই প্রয়োজন আরও বেশি করে বইয়ের। মার্কস,এঙ্গেলস, লেনিনের লেখা পড়ে ভগৎ সিংয়ের চেতনালোকে ওঠে নতুন ঝড়। এই সময় ১৯২৬ সালে তরুণ সমাজকে আরো বেশি করে গণ-আন্দোলনে নিয়ে আসার জন্য প্রতিষ্ঠিত করেন নওজোয়ান ভারত সভা নামক সংগঠন। এই সংগঠন তাদের ইশ্তেহারে স্পষ্ট ঘোষণা করে, ‘দেশকে প্রস্তুত করার ভবিষ্যৎ কর্মসূচি শুরু হবে এই আদর্শ দিয়ে: বিপ্লব জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য। সোজা কোথায় ৯০ শতাংশ মানুষের জন্য স্বরাজ।স্ব রাজ জনগণই অর্জন করবে শুধু তাই নয়, স্বরাজ হবে জনগণের জন্যই।’ এই সময় পাঞ্জাবের কীর্তি কিষান পার্টির সঙ্গেও নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে ভগৎ সিংয়ের। এই পার্টির লক্ষ্য ছিল শ্রমিক কৃষকের পার্টি হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা। এরপরই ১৯২৮ সালের ৮- ৯ সেপ্টেম্বর দিল্লি ফিরোজ শাহ কোটলায় এক ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় এইচআরএ-র। এই সম্মেলন থেকেই প্রধানত ভগৎ সিংয়ের উদ্যোগে সংগঠনের নাম বদলে করা হয় হিন্দুস্তান স্যোসালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন। দলের ইশ্তেহারে তাঁরা নরমপন্থী নেতাদের ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাসের দাবির তীব্র সমালোচনা করে পূর্ণ স্বরাজের দাবির স্বপক্ষে জোরালো বক্তব্য পেশ করেন। পাশাপাশি বলা হয়,‘সর্বহারার সব আশা এখন সমাজতান্ত্রিক কেন্দ্রীভূত। একমাত্র সমাজতন্ত্রই পারে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে এবং সমস্ত সামাজিক পার্থক্য, বিশেষ অধিকার দূর করতে।’
এইচএসআরএ তাদের দলকে সাংগঠনিক এবং সামরিকভাবে বিভক্ত করে। সামরিক বিভাগেরই নাম ছিল হিন্দুস্তান স্যোসালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি। বোমা পিস্তলের বিপ্লব নয় সমাজ পুনর্গঠনের লক্ষ্যেই ব্রতী হয় এই দল। কিন্তু সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলনে পুলিশকর্তা লেনদেন স্কটের ভয়াবহ আক্রমণে লালা লাজপত রাইয়ের মৃত্যু তাঁদের পরিকল্পনায় নতুন বাঁকের সৃষ্টি করে। ১৯২৮ সালে ১৭ডিসেম্বর রাজগুরু এবং ভগৎ সিং গুলি করে হত্যা করেন লাহোর পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার স্যান্ডার্সকে। আজাদের গুলিতে মৃত্যু হয় কনস্টেবল চালান সিংয়ের। পরদিন লাহোর শহরে দেখা যায় সংগঠনের পোস্টার, তাতে লেখা থাকে, ‘মানুষের রক্তপাত করেছি বলে আমরা দুঃখিত কিন্তু বিপ্লবের বেদীর রক্তে ধৌত করার প্রয়োজন ঘটে। আমাদের লক্ষ্য এমন একটি বিপ্লব ঘটানো যা মানুষ কর্তৃক মানুষকে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি দেবে।’
এ হত্যাকাণ্ডের পর লাহোর জুড়ে ধরপাকড় শুরু হলে, ভগৎ সিং ছদ্মবেশে কলকাতায় চলে আসেন। এখানেই তার আলাপ হয় বিপ্লবী যতীন দাসের সাথে। তবে এই সময় ব্রিটিশ সরকার পাবলিক সেফটি বিল এবং এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করতে এলে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সংগঠন। সেই পরিকল্পনামাফিকই ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত আইনসভায় প্রবেশ করে লিফলেট বিলি করেন এবং বোমা নিক্ষেপ করেন। সাথে সাথে বজ্র নির্ঘোষে স্লোগান তোলেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ ’। বৈচিত্র্যের দেশে সেবারই প্রথম বিপ্লবের অমরত্বের স্লোগান! কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবেই তারা আইনসভায় বোমাটি ফেলেছিলেন এমন একটি জায়গায় যেখানে কিছু পরিত্যক্ত চেয়ার টেবিল ছাড়া কিছু ছিল না। এই ঘটনায় মাত্র পাঁচ-ছয় জন আহত হন এবং তার মধ্যে মাত্র একজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। যে লিফলেট তারা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেখানেও লেখা ছিল ,‘ব্যক্তিকে খুন করা সহজ কিন্তু আদর্শকে খুন করা যায় না।’
আইনসভার বোমাবর্ষণের পরে স্বেচ্ছায় ধরা দেন ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত। জেল থেকে লেখা বিভিন্ন চিঠি এবং তার রচনাবলীর মাধ্যমে সুচিন্তিত মতামত তিনি সর্বসাধারণের কাছে ব্যক্ত করেন। দায়রা আদালতে বিচারকের বিপ্লব কী প্রশ্নের উত্তরে সাবলীল ভাবে ভগৎ সিং বলেন, ‘বিপ্লব বলতে আমরা বুঝি শেষ পর্যন্ত এমন একটা সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠান যা এরকম ধ্বংসের ভয়ে ত্রস্ত নয়। যেখানে সর্বহারা সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত যার ফলে আসবে এমন একটা বিশ্ব ফেডারেশন যা বিশ্ব মানবকে উদ্ধার করবে পুঁজিবাদের দাসত্ব থেকে ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের দৈন্য থেকে।’
কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতাদের সাথে তাঁর পার্থক্য ব্যবহার করে তাকে নিজেদের সংকীর্ণ মতাদর্শের সাথে সম্পৃক্ত করতে যায় দেশের শাসক দল। ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত আইনসভায় প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন পাবলিক সেফটি বিলের বিরুদ্ধ। যে বিলে ব্যবস্থা ছিল বিনা বিচারে যে কোনো ব্যক্তিকে আটক করে দীর্ঘকাল কারারুদ্ধ করে রাখার। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে ভারতবর্ষে এখনো বিজেপির হাত ধরে চালু রয়েছে একই ধরনের কালা কানুন ইউএপিএ। সেই আইনেরই অপব্যবহারে জেলে বন্দি বৃদ্ধ কবি ভারভারা রাও অথবা ছাত্রনেতা উমর খালিদ। এইচএসআরএ-র তীব্র বিরোধিতা ছিল ট্রেড ডিসপিউট বিলের বিরুদ্ধে যা শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে। ঠিক একই রকম ভাবে বিজেপি সরকার দেশের শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করে শ্রম আইনগুলো সংশোধন করে চালু করেছে চারটি শ্রমকোড যার মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে শ্রমিকের ধর্মঘটের অধিকার। ভগৎ সিংয়ের প্রতিষ্ঠিত নওজোয়ান ভারত সভা তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিল ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি থেকে দূরে থাকতে। তাদের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় উভয়ই ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন এবং তাকে বিদেশি শত্রুরা ব্যবহার করছে। ব্রিটিশ প্রবর্তিত ডিভাইড অ্যান্ড রুলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তা ছিলেন ভগৎ সিং। বর্তমান ভারতে যখন এনআরসি-র নামে এক শ্রেণির মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে দেওয়ার চক্রান্ত চলে, যখন উর্দু ভাষায় কথা বলার অপরাধে শিক্ষক গ্রেফতার হন, যখন হিজাব পরার অপরাধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢোকার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদই পারে ভগৎ সিংয়ের ঐতিহ্য সযত্নে রক্ষা করতে।
কারাবাসের দিনগুলিতে তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘কেন আমি নাস্তিক’-এ ভগৎ সিং স্পষ্ট লেখেন,‘যে মানুষ প্রগতির পক্ষে পুরাতন বিশ্বাসের প্রত্যেকটি উপাদানকে তার সমালোচনা, সন্দেহ, অবিশ্বাস করতে হয়। প্রচলিত বিশ্বাসের প্রত্যেকটি উপাদানকে ধরে ধরে পরীক্ষা করতে হয়। যুক্তিতর্ক ত্রুটিপূর্ণ, বিপথগামী কোন কোন ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিমূলক হতে পারে কিন্তু তার সংশোধন সম্ভব কারণ যুক্তি ধ্রুবতারা কিন্তু শুধুমাত্র বিশ্বাস অন্ধ বিশ্বাস বিপজ্জনক।’
দেশজুড়ে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য গভীর প্রভাব ফেলেছিল ভগৎ সিংয়ের চিন্তাভাবনায়। মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের অবসানই ছিল তার স্বপ্নালু বিপ্লবের অন্তিম অভিপ্রায়। নওজোয়ান ভারত সভা ব্রিটিশ শাসকের পাশাপাশি দেশীয় পুঁজিপতি এবং পেটিবুর্জোয়াদের সমালোচনা করেন। কিন্তু যে ভারতে মাত্র এক শতাংশ মানুষের হাতে দেশের ৫৮ শতাংশ সম্পদ গচ্ছিত থাকে, যে দেশে আদানির স্বার্থ সুরক্ষার জন্য দিনের পর দিন সরকারি দল ভন্ডুল করে সংসদ অধিবেশন তা কি সত্যিই ভগৎ সিংয়ের স্মৃতি দিয়ে ঘেরা?
তৎকালীন ভারতীয় সমাজে অস্পৃশ্যতার সমস্যা ছিল প্রবল। কীর্তি পত্রিকায় এর বিরুদ্ধে কলম ধরেন ভগৎ সিং। ‘অস্পৃশ্যতার সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি তথাকথিত অস্পৃশ্যদের আহ্বান করেছিলেন নিজের শ্রেণি সত্তাকে উপলব্ধি করে শ্রেণি সংগ্রামে অংশ নিতে। তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোমরাই আসল শ্রমিক শ্রেণি। দুনিয়ার মজদুর এক হও,শৃঙ্খল ছাড়া আর কিছু তোমাদের হারাবার নেই।’
দেশি এবং বিদেশি বিভিন্ন সাহিত্য দর্শন চর্চা ভগৎ সিংকে অনুরক্ত করেছিল বামপন্থায়। স্বদেশ নির্মাণে সমাজতান্ত্রিক কাঠামোকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন তিনি। সোভিয়েতের মডেলে স্বাধীন ভারতবর্ষ গড়ে তোলার পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছিলেন বিভিন্ন রচনায়। এমনকি দণ্ডাজ্ঞার পরেও দেশের যুব সমাজের প্রতি তিনি যে চিঠি লেখেন তাতে লক্ষ্য বলতে তিনি কেবল ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর বোঝেননি, বুঝিয়েছেন সেইসব ভারতীয়দের হাতে রাষ্ট্রের হস্তান্তর যারা সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে গোটা সমাজের পুনর্গঠন সম্পন্ন করবে। কৃষক ও শ্রমিকের সমর্থন চাওয়া। তার কাছে বিপ্লব মানে সর্বহারার বিপ্লব এবং সর্বহারার জন্য বিপ্লব। মৌলিক মার্কসবাদের চর্চার ফলে নতুন ভাবে উদ্দীপ্ত হন ভগৎ সিং। তাঁর জেল ডায়েরির বিভিন্ন পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি সংক্রান্ত মার্কস এবং এঙ্গেলসের মতামত। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লব আলোড়ন ফেলে তাঁর চিন্তার জগতে। ভারতের যুব সমাজকে তিনি তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে আবেদন জানান। এমনকি লেনিনের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে ভগৎ সিং এবং তাঁর সহচররা লাল স্কার্ফ পরে কোর্টে হাজির হন। ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত হতেই তারা স্লোগান তোলেন, ‘ লং লিভ সোস্যালিস্ট রিভলিউশন, লেনিনস নেম উইল নেভার ডাই’। আদালতের অনুমতি নিয়ে তারা তৃতীয় আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাম পাঠান।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে ভগত সিং বরাবর সোভিয়েতকেই চিহ্নিত করেছিলেন। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কমিউনিস্ট নেতাদের প্রতি অবিচারের প্রতিশোধ জ্বলে উঠেছিল ভগৎ সিংয়ের মধ্যে। মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে ১৯২৬ সালে তাঁর যোগাযোগও হয়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর বহু বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ভগৎ সিংয়ের সাথে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়া শিব বর্মা, জয়দেব কাপুর, বিজয় কুমার সিনহা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। স্বাধীনতার পর বিজয় কুমার সিনহা সোভিয়েতে যান স্তালিনের সাথে সাক্ষাতের জন্য। ভগৎ সিংয়ের সাথে লাহোর জেলে অনশনকারী অজয় ঘোষ পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ভগৎ সিংহের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আজ আরও বিপন্ন বিজেপি আরএসএস-এর হাতে। সেই প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য লড়াই চলবে নিরন্তর। সেই লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত অক্সিজেন জুগিয়ে যাবেন ভগৎ সিং।
Comments :0