প্রবীর দাস- বসিরহাট
ইট ভাটায় বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে সংশয় কাটল না ঘটনার প্রায় চব্বিশ ঘন্টা পরও। বসিরহাটে চিমনি ভেঙে পড়ে নিহতদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪। বুধবার বিস্ফোরণে ভেঙে পড়ে চিমনি।
একাংশের বক্তব্য, নাশকতার উদ্দেশ্য থেকে ঘটানো হতে পারে বিস্ফোরণ। আবার পুলিশ এবং প্রশাসনের প্রাথমিক অনুমান, গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে। আরেক অংশের বক্তব্য, চিমনির রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় এত বড় ঘটনা হয়েছে। আহতও হয়েছেন অনেকে।
বুধবার হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে ৯০-১০০ ফুটের চিমনির ৮০-৯০ ফুট অংশ। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থলে এসে তদন্ত শুরু করলে তবেই পরিষ্কার হবে চিমনি ভেঙে পড়ার আসল কারণ। বৃহস্পতিবার এমনটাই পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়। পুলিশ জানায়, চিমনি ভেঙে পড়ার ঘটনায় ৪ জন মারা যান এবং আহত হন ৩ জন।
ইটভাটা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, গ্যাস জমে বিস্ফোরণের তত্ত্ব অসম্ভব এবং অবাস্তব। তাঁরা বলছেন, গ্যাস জমে গিয়ে বিস্ফোরণের গল্প যাঁরা সাজাচ্ছেন তাঁরা ইটভাটার ডাম্পার, চিমনি সম্পর্কে অনভিজ্ঞ।
১৯৬৫-৬৭ সাল থেকে এই ইটিন্ডা, দন্ডিরহাট , ধলতিথা এলাকায় আক্কাজ হাজি, অতুল দাস, উপেন দাস, রাধাবল্লভ সরকারদের হাতে ধরে ইটভাটার পত্তন হয়। ক্রমে ক্রমে অসংখ্য ইটভাটা গড়ে ওঠে বসিরহাট মহকুমা জুড়ে। যার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এর সঙ্গে প্রায় ৪ লক্ষ শ্রমিক তাঁদের পরিবার ক্ষুদ্র, মাঝারি, বড় ব্যবসায়ী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এই কাজে সব মিলিয়ে ১৫ লক্ষের বেশি মানুষ যুক্ত। ইট ভাটায় দুর্ঘটনার পর নিরাপত্তা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলছেন ইটভাটা শিল্পের সাথে যুক্ত মানুষ। তাঁদের বক্তব্য বসিরহাট মহকুমার অর্থনীতির ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় এই ইটভাটা শিল্প। কোনদিন এমন ঘটনা ঘটেনি। বসিরহাট মহকুমার ইটভাটার ইতিহাসে এই প্রথম ঘটলো এমন ঘটনা। বহু ভাটা সাত আট বছর বন্ধ থাকার পর চালু হয়েছে। কিন্তু ‘ফায়ারিং’-র সময় বিস্ফোরণ, মানুষের মৃত্যু, হয়নি। আমরা আতঙ্কিত।
ভেঙে পড়া চিমনির একাংশ।
এমনিতেই সিন্ডিকেট রাজের কারণে কয়লার দাম অতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছে। পাশাপাশি সিমেন্টের তৈরি ইটের আমদানি হওয়ায় গভীর সংকটে ইটভাটা শিল্প। তার উপর বুধবার সন্ধ্যায় বিকট শব্দে হীরা ইটভাটার চিমনি ভেঙে ৪ জনের মৃত্যু এবং বহু মানুষের আহত হওয়ার ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ইটভাটার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক, মালিক ও অন্যান্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে। ব্রিক সাপ্লায়ার্সদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এ-ও জানা গেল যে অতীতে কখনও এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি।
হীরা ভাটাটি এক বছর বন্ধ ছিল। স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী এবারই লিজ নিয়ে ভাটাটি চালু করেন। বুধবার ফায়ারিং হওয়ার সাথে সাথে বিস্ফোরণে উড়ে যায় চিমনির বেশিরভাগ অংশ। ফায়ারিংয়ের সময় ডাম্পারে উপর যাঁরা ছিলেন তাঁরাই নিহত এবং আহত হয়েছেন। যার মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া পাইকারডাঙ্গার বাসিন্দা এক ডাম্পার মিস্ত্রি হাফিজুল মণ্ডল, উত্তর প্রদেশ থেকে আসা দুজন ঝোকাই মিস্ত্রি রাকেশ কুমার, জেঠু রাম ও সোলাদানার বাসিন্দা এবং স্থানীয় একটি ইটভাটার লিজ মালিক অসিত ঘোষ।
যারা কম বেশি আহত হন তাঁদের একজন স্থানীয় তৃণমূল নেতা সঞ্জয় মণ্ডল। ফায়ারিংয়ের সময় সঞ্জয় মণ্ডল ও তাঁর সঙ্গীরা দাঁড়িয়েছিলেন ডাম্পারের উপর থাকা চিমনির অদূরে ঝোকাই মিস্ত্রিদের সাময়িক বিরতির ঘরের সামনে। বসিরহাট জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর বৃহস্পতিবার সকালে সঞ্জয় মণ্ডল সহ কয়েকজনকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানা গিয়েছে। আহতদের মধ্যে একজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাকি আহতরা ধীরে ধীরে সুস্থ হওয়ার পথে।
কাগজে কলমে হীরা ভাটা নাম থাকলেও কৃষ্ণা নামে ভাটাটি বুধবার চালু হয়। বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থল গিয়ে দেখা যায় কৃষ্ণা নামে থরে থরে সাজানো পলিমাটির তৈরি কাচা ইট। জানা গেল এই সঞ্জয় মণ্ডল লিজ মালিকদের একজন। কৃষ্ণা নামে ধলতিথার কাপালিপাড়ায় তার আরও একটি ইটভাটা আছে।
নিহত ডাম্পার মিস্ত্রি হাফিজুল মণ্ডলের বাড়িতে স্ত্রী, বৃদ্ধা মা ও দুই সন্তান। এদিন হাফিজুলের বাড়িতে গেলে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাফিজুলের পরিবার ও প্রতিবেশীরা। অন্যদিকে সোলাদানার বাসিন্দা মৃত অসিত ঘোষের পরিবার জানায়, ওঁকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। আজ সব শেষ। উত্তর প্রদেশ থেকে পরিযায়ী শ্রমিক ৬ জন ঝোকাই মিস্ত্রি এই ভাটায় আসে ফায়ারিংয়ের কাজে। জেঠু রাম ও রাকেশ কুমার মারা যান ফায়ারিংয়ের সময়। বাকি ৪জন ঝোকাই মিস্ত্রিদের একটাই কথা, ‘উন দোনো কা পরিবারকা ক্যায়া হোগা?’
কমবেশি ৫০০ শ্রমিক এই ভাটায় কাজ নিয়েছিলেন। তাঁরা বলছেন, সামনের রবিবার সাপ্তাহিক পেমেন্ট ছিল। কী হবে তার? ভাটা তো বন্ধ হয়ে গেল। ফের কী কাজ পাবো?
Comments :0