2022 World Cup final

তীরে পৌঁছলেন স্বপনপারের নেয়ে

খেলা

2022 World Cup final

ছেলেটা বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদত, যেন তার কান্নার আওয়াজ শোনা না যায়। কোথায় রোসারিও, আর কোথায় দূর দেশ বার্সেলোনা। ১৩ বছরের ৪ ফুট ৮ ইঞ্চির ছেলেটাকে রেখে চলে গেছে তার মা, দাদা, বোন। বাবা সঙ্গে আছেন, কিন্তু তার পাড়া নেই, ফুটবল নিয়ে খেলে বেড়ানোর এবড়ো খেবড়ো মাঠ নেই, বন্ধু নেই, মনের কথা বলার কেউ নেই। 


বলের সঙ্গেই কথা বলা শুরু করল ছেলেটা। ১০ বছর বয়সে হর্মোন ঘাটতির অসুখে ভুগছিল ছেলেটা। রোজ নিজের পায়েই নিজে ইঞ্জেকশন নিত। কিন্তু এই অসুখের      চিকিৎসা ব্যয়সাধ্য, তার ছোটবেলার ক্লাব নিউয়েলস ওল্ড বয়েজ প্রথমে খানিকটা দায়িত্ব নিলেও পরে আর নেয়নি। আর্জেন্টিনায় তখন তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট, ছেলেটার পরিবারেও তার গভীর ছায়া। খোঁজ পেয়েছেন বার্সেলোনার স্পটাররা, তারাই স্পেনে নিয়ে এসেছিলেন ছেলেটাকে। 

 


বার্সেলোনার ফুটবলার তৈরির স্কুল লা মাসিয়া আসলে হীরের খনি। জাভি, ইনিয়েস্তা, পিকে, ফেব্রেগাস থেকে স্বয়ং পেপ গুয়ার্দিঅলা। বাচ্চা ছেলেটা সেখানে বল নিয়ে খেলতে শুরু করে। মুখ ফুটে তার কোনও কথা বেরতো না, সতীর্থরা ডাকত ‘এল মুদো’, যে কথা বলে না। ফেব্রেগাস বয়সে বড়, পরে স্মৃতিচারণে বলেছেন, অনুশীলনে একদিন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসাবে আমি খেলছিলাম। বাচ্চাটা রোগাসোগা, আমি ভাবলাম এর কাছ থেকে বল কাড়তে এক সেকেন্ডও সময় লাগবে না। ট্যাকল করলাম, কোথায় বল নিয়ে চলে গেল, আমি পড়ে রইলাম মেঝেতে। সেদিনই মনে মনে বলেছিলাম, ‘এ যে-সে বাচ্চা নয়’। 


সময় গেলে থিতু হলো ছেলেটা। ফুটবলের নতুন নতুন পদ্ধতি শিখল। পদ্ধতি, মেথড, আর কিছু অন্য কারো কাছ থেকে শিখতে হয়নি তাঁকে। কিন্তু রোসারিও জানল না, রোসারিওর মন থেকে মুছে গেল ছেলেটা। পরে একটা ভিডিও দেখতে পাওয়া যায়। জোব্বার মতো দেখাচ্ছে বার্সার জার্সি, তার থেকে আয়তনে এবং বয়সে অনেক বড় স্পেনীয় টিনএজারদের স্রেফ নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। 

 

 

আর্জেন্টিনার যুব দলের কোচ হুগো টরিসেলি সেই ভিডিও হাতে পেয়েছিলেন, কিন্তু ছেলেটাকে কেমন অবাস্তব দেখাচ্ছিল, এমন আবার হয় নাকি, তার ওপরে ছেলেটা বিদেশে থাকে। টরিসেলি ছেলেটাকে ডাকেননি। আর্জেন্টিনা ছেলেটাকে ডাকেনি। 
স্বদেশকে ডেকেছিল ছেলেটাই। স্পেনের ফুটবল মহল তখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে, খবরে খবরে ছয়লাপ হয়ে যাচ্ছে বিস্ময় কিশোরের কথা, বলা হচ্ছে এই ছেলেটা ‘অন্য গ্রহের’। স্পেনে পাঁচ বছর কটানোর পরে সে-দেশের নাগরিকত্বও পেয়ে যায় ছেলেটা। ‘লা রোজা’-য় খেলতে পারতেন। কিন্তু লিওনেল মেসি অপেক্ষা করেছেন আর্জেন্টিনার ডাকের জন্য। পেকারম্যান তাঁকে ডেকেছেন অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে, মেসির শরীরে উঠেছে সেই জার্সি যা মারাদোনা পরতেন। 

 


মারাদোনা। মেসি তাঁকে বিশ্বকাপ পেতে দেখেননি। কিন্তু তাঁর সারা জীবন কেটেছে মারাদোনার দীর্ঘ ছায়ায়। আর্জেন্টিনার মানুষ বলেছেন, দিয়েগো দারিদ্র থেকে উঠে এসেছেন, তিনি এই বিশ্বের যাবতীয় প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, তিনি অশান্ত কিন্তু সেই কারণেই দুর্দান্ত, তাঁর জীবনে ক্ষত আছে কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রোও ছিলেন। তিনিই আর্জেন্টিনীয়। মেসি শিল্পীর মতো খেলেন, কিন্তু সেই স্পৃহা নেই, নির্লিপ্ত, আগুন কই? মেসি আসলে স্পেনের। 


মেসি চেষ্টা করে গেছেন। তাঁর দেরাজ ভরে উঠেছে ট্রফিতে ট্রফিতে, ফুটবলের ইতিহাসে প্রায় এমন কোনও প্রণিধানযোগ্য রেকর্ড নেই যা তাঁর পায়ের সামনে ধুলোয় মিশে যায়নি, বার্সেলোনার প্রথম আদর তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন ৩৪টি ট্রফি দিয়ে, পরপর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দিয়ে, নিজে পেয়েছেন সাতবারের ব্যালন ডি’অর। কিন্তু আর্জেন্টিনাকে কিছু দিতে পারছিলেন না। ২০১৪ থেকে ২০১৬’র মধ্যে পরপর তিন বছর মেসি বিশ্বকাপ এবং কোপা আমেরিকার ফাইনালে দেশকে তুলেও জিততে পারেননি। চিলির কাছে কোপায় পেনাল্টি শুট আউটে হারার পরে লকার রুমে ভেঙে পড়েছিলেন মেসি। তাঁর প্রাণের বন্ধু আগুয়েরো জানিয়েছেন, এত খারাপ অবস্থায় কখনও দেখিনি ওকে। মেসি জানিয়ে দেন, অন্য যে কারোর থেকে আমি বেশি ব্যথিত, কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে আমি পারব না। আমি আর দেশের হয়ে খেলব না। 

 


সেই বিদায় বার্তা কাঁপিয়ে দেয় আর্জেন্টিনাকে। ‘নো তে ভায়াস লিও’, যেও না লিও, ভেসে আসে সমুদ্র থেকে পাহাড়ের ডাক। যাননি, স্বদেশের টান আবার তাঁকে ফিরিয়ে আনে ২০১৮-র বিশ্বকাপে। পারেননি, শুধু কেঁদে উঠতেন মাঝে মাঝেই। ২০২১-এর কোপা আমেরিকায় মারাকানায় ব্রাজিলের বিরুদ্ধে শেষ বাঁশি বাজার পরে মাঠের এক প্রান্তে বসে কাঁদছিলেন মেসি। ছুটে এসে তাঁকেই তুলে ধরে ট্রফির মতো নাচাতে থাকেন সতীর্থরা। ২৮ বছর পরে আর্জেন্টিনা কোনও ট্রফি পেল শুধু এই আনন্দই নয়, যেন মেসিকেই জিতে নিয়েছে আর্জেন্টিনা। 


এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা এসেছিল ৩৬ ম্যাচে অপরাজিত থেকে। ফাইনালের আগে পর্যন্ত মোট ৪০ ম্যাচের মাত্র একটিতে তারা হেরেছে। ৩৫ বছরের মেসি, বিস্ময় বালক নন, কিন্তু বিস্ময়। আরও একবার সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে জাদুময় খেলায় আর্জেন্টিনাকে টেনে তুলেছেন ফাইনালে। গান বাঁধা হয়েছে তাঁর নামে, ‘আরও একবার আমরা আশায় বেঁধেছি বুক’। একটা দেশ, তার জন্য আর বহু আগে হারিয়ে যাওয়া এক সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে সেই গানে ভরে উঠেছে মরুশহরের রাস্তা। সাংবাদিক সম্মেলনে এসে প্রশ্নের বদলে আর্জেন্টিনার টেলিভিশন সাংবাদিক সোফিয়া মার্টিনেজ মেসিকে বললেন, ‘ফাইনালে যা-ই ফল হোক লিও তুমি আমাদের যা দিয়েছ তা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আর্জেন্টিনার প্রত্যক শিশুর আছে তোমার জার্সি, কেনাই হোক বা বানানো। প্রত্যেকের জীবনে তুমি আছো লিও। যে কোনও বিশ্বকাপের থেকে তা বড়।’ নিঃশব্দ প্রেস রুমে লিও শুনছিলেন নীরবে, ছলছল করছিল তাঁর চোখ। 


মেসি আর্জেন্টিনার, কিন্তু মেসির ফুটবল বিশ্বজনীন। খেলেছেন ইউরোপের মাঠে, কিন্তু লাতিন আমেরিকার রৌদ্র ও ছায়া খেলা করে গেছে তাঁর পায়ে। দুই মহাদেশের ঘরানার এক আশ্চর্য সেতুবন্ধন করেছেন তিনি। মাঠে তিনি ফরাসি শিল্পী ইয়েভেস ক্লেইনের ‘মনোটোন সিম্ফনি’, কিছুক্ষণের কর্ডের পরে কিছুক্ষণের নীরবতা। মিনিমালিস্ট, যা নিতান্ত প্রয়োজন তার বেশি কিছু কোরো না। মেসি বল পাওয়ার জন্য ছটফট করেন না, বল পাওয়ার পরে ছটফট করেন না। তিনি যে প্রায় ঔদাসীন্যে ঘোরাফেরা করেন তা আসলে এক ছবি আঁকার পরে পরেরটির জন্য রঙে তুলি ডোবানোর আগে ইজেলকে ভালো করে দেখে নেওয়া। এক জ্যামিতি থেকে অন্য জ্যামিতিতে চলে যাওয়া। 


কিন্তু মেসি রঙের বন্যাও। ১৯ বছরের মেসিকে দেখা গেছে পাঁচজন ডিফেন্ডারকে আলাদা আলাদাভাবে অতিক্রম করে গোলকিপারকে টলিয়ে দিয়ে গোল করে আসতে। দেখা গেছে, ২০১১-র চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের গোটা মাঝমাঠ এবং রক্ষণকে একাই ড্রিবল করে গোল করতে। দেখা গেছে বেয়ার্নের জেরোমে বোয়েতাঙ্গের পায়ের তলা থেকে হঠাৎই মাটি উধাও করে দিয়ে বিশ্বের সেরা গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে চিপ করে দিতে। দেখা গেছে, এই সেদিনও নেদারল্যান্ডস ম্যাচে দলের তৃতীয় গোলের সময়ে ঘূর্ণন। ফাইনালে তিন তিনবার বিপক্ষের জালে বল ছুঁইয়েছেন, অসংখ্য বল তৈরি করেছেন তাঁর সতীর্থদের জন্য। তারপর সেই যে ছেলেটা, আবার কেঁদেছে। নতুন কান্না, বিশ্বজয়ের অশ্রু। এবার তার চোখের জল মুক্তোর মতো। 
ফুটবল যে নিছক বীর ও বিজয়ীর নয়, তা যে নন্দনতত্ত্বও, ১০০৩ ম্যাচ থেকে সেই সুর চিরকালের মতো বাজিয়ে রেখে গেছেন লিও। হাজার হাজার রাতে সেই স্বরলিপি বেজে উঠবে স্বপ্নের মধ্যে, কোথাও হারাবেন না লিও। 

Comments :0

Login to leave a comment