ম্যাচ শেষে হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন নেইমার। তাঁর তো কান্নারই কথা। তাঁর চমৎকার গোল ধরে রাখতে পারল না বাকি দল। কয়েক মূহূর্তের মনঃসংযোগে ঘাটতি ব্রাজিলের রক্ষণে ফাটল ধরিয়ে দিল। ব্রাজিলের গোলে একটি মাত্র শট এবং সেটিই গোল। খেলা টাইব্রেকারে গড়ালো এবং বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল ব্রাজিল। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি অনুরাগীর জন্য বিশ্বকাপের দীপ নিভে গেল।
প্রথমার্ধের খেলা সমানে সমানেই হয়েছে। তবে ট্যাকলিট্যালি ছিল ক্রোয়েশিয়া। এর কৃতিত্ব অনেকটাই ক্রোয়েশিয়ার কোচ দালিচের। লুকা মড্রিচরাই মূলত প্রথম ৪৫ মিনিট ম্যাচটা নিয়ন্ত্রণে করেছে। ব্রাজিলকে খেলতে না দিয়ে। ব্রাজিল সচরাচর যেরকম খেলে, মাঝমাঠ দখলে রেখে দু’প্রান্তকে ব্যবহার করে সুইচ ওভার ফুটবল। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলাররা মাঝমাঠকে নিজেদের দখলে রাখায়, ব্রাজিল নিজেদের খেলাটা ছড়াতে পারেনি। তার একটা কারণ, ক্যাসেমিরো কিছুটা নিস্প্রভ থাকায়।
ক্রোয়েশিয়া কিন্তু আলাদাভাবে কোনও ফুটবলারদেরকেই মার্কিং করেনি। তবে যখনই ভিনসিয়াস জুনিয়র, নেইমাররা বল নিয়েছিল নিজেদের পায়ে, ডাবল মার্কিং করে নিখুঁত ফাইনাল ট্যাকল করে বল ছিনিয়ে নিচ্ছিল। নেইমারদের খেলতে না দেওয়ার জন্য ক্রোয়েশিয়া মাঠটাকে সুন্দর ভাগ করেছিল, ডিফেন্ডার, মিডফিল্ডার ও আক্রমণভাগ খেলোয়াড়দের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে। নিজেদের মধ্যে একাধিক পাস খেলতে দেখা গিয়েছে ক্রোয়েশিয়াকে। তারপরও ব্রাজিল প্রায় গোল মুখ খুলে ফেলেছিল, মাত্র তিন টাচ খেলে শেষ অবধি গোল করতে পারেননি যদিও। নেইমার যে ফ্রিকিকটা মারলেন, ডিফলেকশনে গোল হতে পারতো, ক্রোয়েশিয়া গোলকিপার লিভাকোভিচ ফিট বলেই বাঁচিয়ে দিয়েছে। ব্রাজিল যে কটা সুযোগ তৈরি করেছিল, আহামরি কিছু নয় সেগুলি। অন্যদিকে, ক্রোয়েশিয়া দু’প্রান্তকে ব্যবহার করে গোলের রাস্তা বানালেও, জুরানোভিচের ক্রস থেকে পা ছোঁয়ালেই গোল হতে পারতো, বক্সে দাঁড়ানো ক্রোট ফুটবলারটিকে জায়গা মতো পৌঁছাতে পারেনি। ব্রাজিলের ডিফেন্ডার থিয়াগো সিলভার প্রশংসা করতেই হয়, এই বয়সেই কি নিঁখুতভাবে বল ক্লিয়ার করছেন। বিপক্ষের গাভারদিওল ছিলেন অনবদ্য।
প্রথমার্ধে খেলা দেখেই আন্দাজ করেছিলাম, ম্যাচটা অতিরিক্ত সময়ে যাবে। সেটাই হল অবশেষে। কারণ, ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলাররা কোচের পরিকল্পনা ঠিকঠাকভাবে প্রয়োগ করেছে। জাপান, সৌদি আরব এই বিশ্বকাপে দেখিয়েছে, বল তাড়া করে একটা দলের আক্রমণ শেষ করে দেওয়া যায়। এই ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া দেখাল, কিভাবে ডিফেন্স, হাফলাইনের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে বিপক্ষের আক্রমণের রাস্তায় ঝাঁপ ফেলে দিতে হয়। মড্রিচ এত ভালো ফুটবল খেলেছে। তেমনই ডিফেন্স। দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিলের খেলায় কিন্তু তীক্ষ্ণতা বেড়েছিল। সুযোগও তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু কখনও ব্রাজিলের ফুটবলাররা বারের উপর দিয়ে মেরেছে, কখনও দুর্বল শটে গোলকিপারের হাতে তুলে দিয়েছে বল। একটা দু’টো লিভাকোভিচ দারুণ সেভ করেছে। নেইমার এদিন ভালো খেলেছেন। তিতেকে দেখা গেল, পরিবর্তন করতে। রিচার্লিসন, ভিনিসিয়াসকে তুলে নিলেন বাধ্য হয়ে। বুঝতে পারছিলাম ব্রাজিলকে গোল করতে হলে, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে করতে হবে। প্রথমে তিনটে টাচে ব্রাজিল খেলা তৈরি করে, শেষ অবধি বলটা পায় নেইমার। গোলকিপারকে কাটিয়ে একক দক্ষতায় ব্রাজিলকে এগিয়ে দিয়েছিল। অসাধারণ একটি গোল কিন্তু কোনো লাভ হলো না।
ক্রোয়েশিয়া শুধু ডিফেন্স করে গেছে এমনও নয়, তারাও আক্রমণেও যাচ্ছিল। যদিও ক্রোয়েশিয়ার পরিকল্পনায় ছিল ম্যাচটাকে টাইব্রেকারে নিয়ে যাওয়া। সেটাই করল ম্যাচ শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে সমতা ফিরিয়ে। প্রতি আক্রমণে গোল দিয়ে। ব্রাজিলের মুহূর্তের শিখিলতাকে কাজে লাগিয়ে পাসের দমক ভাঙে মড্রিচই। ওরসিচের পাসে গোলটা করল পেটকোভিচ। ১১৬ মিনিটে গোল খেয়ে যাওয়ায় ব্রাজিল দলটার মনোবল পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছিল। টাইব্রেকারে বাজিমাত করার রেকর্ড রয়েছে ক্রোয়েশিয়ার। সেটাই করে দেখাল। ব্রাজিল পারলো না। ক্রোয়েশিয়া অদম্য লড়াইয়ের ফসল। আমি বলবো ফুটবলে লড়াইয়ের কোন বিকল্প হয় না। এটাও বলে রাখি, টাইব্রেকারে প্রথম শট নেইমারের মারা উচিত ছিল।
Brazil quarter final
স্বপ্ন স্বখাত সলিলে
×
Comments :0