এসএসসি’র শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ কেলেঙ্কারির তদন্তের অন্যতম ভিত্তি ছিল অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগের নেতৃত্বাধীন অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট।
এসএসসি দুর্নীতিকে বেআব্রু করেছিল সেই বাগ কমিটির রিপোর্ট। আর সেই রিপোর্টই প্রথম জানায় এসএসসিকাণ্ডে তৈরি সরকারের ‘নিয়োগ নজরদারি কমিটি-ই অবৈধ ও বেআইনি’! অর্থাৎ দুর্নীতি ঠেকাতে যে কমিটি তৈরি করা হয়েছিল সেটাই ছিল বেআইনি এবং অবৈধ! এই বেআইনি কমিটি তৈরি হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির নির্দেশেই।
২০১৯ সালের ২৮মার্চ। তার প্রায় একমাস আগে থেকেই এসএসসি’র বঞ্চিত, যোগ্য, মেধাবী চাকরিপ্রার্থীরা কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন শুরু করেছিলেন। লোকসভা ভোটের আগে সেখানেই তখন হাজির হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হ্যান্ডমাইক হাতে বলেছিলেন ‘আমি পার্থদাকে (পার্থ চ্যাটার্জি) বলেছিলাম, পাঁচজনের একটা কমিটিও তৈরি হয়েছে। পার্থদা যে কমিটি তৈরি করেছে, সেই কমিটির সঙ্গে কথা বলে, আমি দেখতে চাই, কীভাবে এটা সামলানো যায়।’
‘সামলাতে’ গিয়ে যে কমিটি তৈরি করেছিলেন পাঁচ সদস্যদের, আদালত সেটাকেই বেআইনি ঘোষণা করেছিল। বাগ কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, এই বেআইনি নিয়োগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে পার্থ চ্যাটার্জির তৈরি করা নিয়োগ নজরদারি কমিটির। মেয়াদ উত্তীর্ণ প্যানেল এবং প্যানেলের বাইরের প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। তারপর মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি সব জেনেই নিয়োগপত্র দিতেন।
জানতেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই ভোটের সময় সামাল দিতে গিতে গিয়েছিলেন। ২০১৯’র ভোটের সামাল দেওয়ার কথা বলেছিলেন, ২০২৪’র লোকসভা ভোটের সময় সেই ‘সামাল দেওয়ার’ ভয়াবহ ছবি সামনে এল কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে।
তারও আগে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির ছবি সামনে এসেছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি সুরঞ্জনা চক্রবর্তী কাছ থেকে। তৃণমূলের তৎকালীন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার তৃণমূল নেতা প্রদীপ মণ্ডলের স্ত্রী মমতা মণ্ডলের চাকরি না হওয়ায় দুর্নীতির সমস্ত তথ্য ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। প্রদীপ মণ্ডল আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার পরই, সুরঞ্জনা চক্রবর্তীর অডিও টেপ প্রকাশ্যে আসে। তাতে শোনা যায় সুরঞ্জনা চক্রবর্তী বলেছিলেন, যা হয়েছে দলের নির্দেশেই হয়েছে। টেটের পর প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের মেরিট লিস্ট অ্যানালিসিস হয়েছে তৃণমূল ভবনে।’
তখনও আদালতের হস্তক্ষেপ, সিবিআই-ইডি’র তদন্ত শুরু হয়নি। তাই ২০১২ তে দুর্নীতির ছবি ধরা পড়ার পরেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীরব ছিলেন। তখন সবে ক্ষমতায় এসেছেন, ফলে সামলে নেওয়া যাবে ভেবেছিলেন! রাজ্যের বিরোধী দলনেতা প্রাথমিকের নিয়োগে মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ থেকে অনেককে চাকরি দিয়েছিলেন টাকার বিনিময়ে— একাধিকবার অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই অভিযোগের ভিত্তিও আছে। কিন্তু তখন শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলের সম্পদ তাই ব্যবস্থা নেয়নি মুখ্যমন্ত্রী। অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়া হতো; তা আদালত বা কেন্দ্রীয় এজেন্সির বলার অনেক আগেই জানতেন মুখ্যমন্ত্রী!
সোমবার আদালতের লিখিত রায়েও স্পষ্ট ইঙ্গিত তেমনই। মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রীসভার বৈঠকেই এসএসসি’র তরফে সুপারনিউম্যা রিক বা অতিরিক্তি পদ তৈরির যে বেআইনি সুপারিশ করা হয়েছিল তাতে সিলমোহর দেওয়া হয়েছিল। ২০২২ সালের মে’র মন্ত্রীসভার বৈঠকে। নিয়োগ দুর্নীতিকে সরকারি সিলমোহর দিয়েছিল তৃণমূল সরকারের মন্ত্রীসভা। তার দায় মুখ্যমন্ত্রী এড়াতে পারবেন?
এমনকি নিয়োগ দুর্নীতির অন্যতম মাস্টারমাইন্ড, গত প্রায় দু’বছর ধরে জেল খাটা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি গত বছর আগস্টে আলিপুর আদালতের এজলাসে নিজের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে টেনে এনেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে। এজলাসে দাঁড়িয়ে তিনি দাবি করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া নিয়োগ হয়নি। সওয়ালে বলেছিলেন— মন্ত্রী নিয়োগ কর্তা নয়। শিক্ষা দপ্তরের কার্যক্রম দুটি ভাগে হয়। একটা অংশ হলো পলিসি তৈরি করে, আরেকটা হলো এক্সিটিউভ ফাংশন। পার্থ চ্যাটার্জি সওয়ালে বলেন— মন্ত্রী তাঁর দপ্তরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলেন। প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি রিপোর্ট করেন মুখ্যসচিবের কাছে, যা আসলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে করারই শামিল। মুখ্যসচিব মুখ্যমন্ত্রীকে জানান। ক্যাবিনেট সেক্রেটারি রিপোর্ট করেন মুখ্যমন্ত্রীকে। নিয়োগের রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে যেতো।
অর্থাৎ এই বেআইনি নিয়োগ প্রক্রিয়া গোটাটাই জানতেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও ঐ একবারই মুখ ফসকে বলে দেবার পর থেকে যতবার আদালতে হাজির হতেন ততবার তৃণমূলের হয়ে বাড়তি গরজ থেকে সাফাই গাইতেন!
অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী জানতেন ‘ইঁদুর পচার মতো দুর্গন্ধ’ বেরোনো এই নিয়োগ দুর্নীতির গোটা প্রক্রিয়াই। অথচ ২০২২ সালের ২২জুলাই নাকতলার বাড়ি থেকে পার্থ চ্যাটার্জির গ্রেপ্তার হওয়ার ৭২ ঘণ্টা পরেই বিশিষ্টজনদের নিয়ে এক সরকারি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন— ‘এত টাকা উঠল আমি তো জানবো! কোত্থাও থেকে জানতে পারলাম না। যদি কেউ অন্যায় করে থাকে সেটা তার দায়িত্ব, সরকার ও দল এরসঙ্গে কোনোভাবে জড়িত থাকবে না। অযথা আমার গায়ে কালি লাগানোর চেষ্টা করলে, আলকাতারা কিন্তু আমার হাতেও আছে।’ সেই আলকাতরা যে আসলে হাজার হাজার যোগ্য, বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের ভবিষ্যতের গায়েই লাগানো হয়েছে ঘটনাক্রমেই তা স্পষ্ট।
‘স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) একটি দুর্নীতির আখড়া।’ দু’বছর আগে এমনই মন্তব্য করেছিল আদালত। এসএসসি’র গ্রুপ-ডি এবং গ্রুপ-সি পদে শিক্ষাকর্মী নিয়োগ এবং নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে। কমিশন এই অবৈধ নিয়োগকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এব্যাপারে কমিশনের পক্ষ থেকে চারটি হলফনামা আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মেধা তালিকায় রয়েছেন এমন যোগ্যপ্রার্থীদের নিয়োগের ব্যাপারে কার্যকরী সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছিল না পরিকল্পিতভাবে।
দিল্লি এবং গাজিয়াবাদে গিয়ে সিবিআই হার্ডডিক্সের যে তথ্য উদ্ধার করেছিল সেখান থেকে জানা গিয়েছিল, পরীক্ষায় শূন্য পেয়েছেন এমন প্রার্থীদের খাতায় ৫২ এবং ৫৩ নম্বর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যাঁরা ২ বা ৩ নম্বর পেয়েছিলেন তাঁদেরও ৫২ থেকে ৫৩ নম্বর দেওয়া হয়েছে। সাদা খাতা জমা দিয়েছেন এমন বেশ কিছু প্রার্থীর খাতায় পাশ নম্বর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসএসসি’র প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্যের কম্পিউটার থেকে যে হার্ডডিক্স পাওয়া গিয়েছে সেখান থেকেই কারসাজির বেশি তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তিনি যখন এসএসসি’র চেয়ারম্যান ছিলেন সেই সময়ই এই বেআইনি ঘটনা বেশি ঘটেছে। সেই সুবীরেশ ভট্টাচার্য এখন জেলে রয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট মিটিংয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে ডি-লিট দেওয়ার প্রস্তাবও এনেছিলেন এই ব্যক্তিই।
Comments :0