আর জি করের ঘটনায় পুলিশি তদন্তে কালক্ষেপ নিয়ে বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে কড়া প্রশ্নের মুখে পড়লো পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কেন সকালে মৃতদেহ উদ্ধার হলেও প্রায় ১৪ ঘণ্টা পরে এফআইআর দায়ের করা হলো, কেন মৃতদেহের শেষকৃত্যের আগে এফআইআর দায়ের করা হয়নি, কেনই বা ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ জানা হয়ে গেলেও তারপরে প্রথমে কারণ অনুল্লেখিত রেখে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করা হলো, কেন তার ১৫ মিনিটের মধ্যে এফআইআর দায়ের হয়ে গেল, কেনই বা মৃতদেহ উদ্ধারের জায়গাটি সিল না করে দীর্ঘ সময় অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল— একের পর এক প্রশ্নে এদিন আবার শীর্ষ আদালতে নাস্তানাবুদ হলো রাজ্যের তৃণমূল সরকার ও তার পুলিশ। সিবিআই’র তরফেও এদিন আর জি করে চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ-খুনের ঘটনা চাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ জানানো হয়। আইনজীবীর মাধ্যমে সিবিআই প্রধান বিচারপতির বেঞ্চকে বলে, তারা ঘটনার ৫ দিন পরে তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে। স্থানীয় পুলিশ যা সংগ্রহ করেছিল, তা তাদের দিয়েছে। কিন্তু এই তদন্ত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কারণ, তত দিনে অকুস্থল বদলে ফেলা হয়েছে।
এদিন সব প্রশ্নেই ভিডিওগ্রাফি রয়েছে বলে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করেন রাজ্য সরকারের আইনজীবী কপিল সিবাল। তবে শীর্ষ আদালত তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। বরং কেস ডায়েরি ধরে পরপর প্রশ্ন করে গিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সহ তিন বিচারপতি। একসময়ে বেঞ্চের অন্যতম সদস্য বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা বলেই দেন, ‘‘আমি আমার ৩০ বছরের আইনের কেরিয়ারে এমন ভাবে তদন্ত হতে দেখিনি। আপনি যদি ময়নাতদন্তের আগে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করেন, তবে কিসের ভিত্তিতে করলেন। যদি ময়নাতদন্তের পরে অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা দায়ের করে থাকেন, তবে তখন অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা কেন দায়ের করলেন, তখন তো মৃত্যুর কারণ জেনেই গিয়েছেন!’’ প্রধান বিচারপতিও বলেন, সকাল নটায় দেহ উদ্ধারের প্রায় ১৪ ঘণ্টা পরে এফআইআর! তিনি এর কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেন ১৪ ঘণ্টা দেরিতে এফআইআর দায়ের হলো? কেন অধ্যক্ষ এফআইআর দায়ের করতে এলেন না? তাঁকে কি কেউ বাধা দিচ্ছিল? কেন তাঁকে বদলি করে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হলো? এই সবের কারণ জানতে চায় আদালত। বেঞ্চের আরেক সদস্য বিচারপতি মনোজ মিশ্রও ময়না তদন্ত এবং এফআইআর দায়েরের সময়ের মধ্যে বিরাট ব্যবধান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ এদিন রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেই আরও বলেছে, পরের দিনের শুনানিতে কোনও দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসারকে আদালতে উপস্থিত থাকতে হবে তদন্তের বিভিন্ন ধাপ নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য। শীর্ষ আদালত মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছে ৫ সেপ্টেম্বর।
আর জি করে চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট যে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের করেছে, প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে এদিন ছিল তার দ্বিতীয় শুনানি। এর আগে গত ২০ আগস্ট এই মামলার প্রথম শুনানিতে খুনকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা, মা-বাবাকে মেয়ের মৃতদেহ দীর্ঘ সময় দেখতে না দেওয়া, নিজে ইস্তফা দেওয়ার পরেও হাসপাতালের অধ্যক্ষকে অন্য হাসপাতালে নিয়োগ করা, খুন-ধর্ষণের ঘটনায় এফআইআর দায়েরে দেরি করা, ১৪’র রাতে হাসপাতালে হামলা আটকাতে পুলিশের ব্যর্থতা— আর জি করের ঘটনায় একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার এবং কলকাতা পুলিশের ভূমিকা। সেদিনও কোনও প্রশ্নেরই সদর্থক উত্তর দিতে পারেননি রাজ্য সরকারের আইনজীবী কপিল সিবাল। সেদিন শীর্ষ আদালত বৃহস্পতিবার তদন্তের অগ্রগতির রিপোর্ট জমা দিতে বলেছিল সিবিআই-কে। সেই সঙ্গে রাজ্য সরকারকেও আর জি করে হামলার ঘটনার তদন্তের অগ্রগতির রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছিল। উভয়েই এদিন রিপোর্ট পেশ করে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চের কাছে। সেই রিপোর্ট এবং কেস ডায়েরি ধরেই এদিন প্রধান বিচারপতি বলেন, একটি বিষয় খুবই উদ্বেগের। কেস ডায়েরি অনুসারে, অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগ দায়ের (জেনারেল ডায়েরি) হয়েছে সকাল দশটা দশে। পুলিশকে তখন ঘটনা জানানো হয়েছে। অথচ অপরাধস্থল ঘিরে দেওয়ার কাজ করা হয়েছে রাতে। এরপরেই অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগে মামলা দায়ের এবং অটোপসি তথা ময়নাতদন্তের সময় নিয়ে প্রশ্ন তোলে বেঞ্চ। বস্তুত, বেঞ্চ এদিন অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগে জেনারেল ডায়েরি এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগে মামলা দায়েরের মধ্যে আইনগত পার্থক্যকে তুলে ধরেই রাজ্য সরকারকে চেপে ধরে। বিচারপতি পারদিওয়ালা রাজ্য সরকারের আইনজীবী কপিল সিবালের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনারা যখন মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে গেলেন, তখন অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছিল কি হয়নি? যদি অস্বাভাবিক মৃত্যু না হয়ে থাকে, তাহলে ময়নাতদন্তের দরকার হলো কেন? আপনারা যখন ময়নাতদন্ত শুরু করলেন, তখন এটা ছিল অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা। অথচ অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগে মামলা (২০২৪ সালের ৮৬১ নম্বর) পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত করা হয়েছে রাত সাড়ে এগারোটায়, আর রাত পৌনে বারোটায় দায়ের এবং নথিভুক্ত করা হয়েছে এফআইআর। এই নথি কি ঠিক?’’ রাজ্য সরকারের আইনজীবী কপিল সিবাল তখন যুক্তি দেন, অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে দুপুর পৌনে দুটোয়। তিনি দাবি করেন, ওই সময়েই সেই মামলা দায়ের করা হলেও তদন্তকারী অফিসার মৃতদেহর শেষকৃত্য সহ সব কাজ সেরে থানায় ফিরে রাত সাড়ে এগারোটায় তা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত করেছেন। যে অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ইনকোয়েস্ট হয়েছে, তিনি তাঁর রিপোর্টে দুপুরের ওই সময় উল্লেখ করেছেন। সেই সময়ের উল্লেখ রয়েছে ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও। বিচারপতি পারদিওয়ালা আরও প্রশ্ন তোলেন, কখন ময়নাতদন্ত হয়েছিল? রাজ্য জানায়, সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটের মধ্যে। তখন বিচারপতি পারদিওয়ালা বলেন, তাহলে রাত সাড়ে এগারোটায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগে মামলা নথিভুক্ত হবে কেন? তখন তো ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে এসে গিয়েছে। তাতে তো মৃত্যুর কারণ বলে দেওয়া হয়েছে। তারপরেই রাত পৌনে বারোটায় মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে এফআইআর দায়ের করা হলো! এই প্রশ্নে নীরব থাকেন রাজ্য সরকারের আইনজীবী কপিল সিবাল। আইনজ্ঞ মহলের মতে, এদিনের শুনানিতে স্পষ্ট হয়েছে, কলকাতা পুলিশ মৃতদেহর ময়নাতদন্ত ও শেষকৃত্য দ্রুত শেষ করতেই ব্যস্ত থেকেছে। তাই কেস ডায়েরিতে নানা আইনি পদক্ষেপের সময় উল্লেখে এত অসামঞ্জস্য রয়েছে।
Comments :0