Heavy Rain South Bengal

ভারী বৃষ্টিতে বেহাল দক্ষিণবঙ্গ, এখন নদী সংস্কারের উদ্যোগ সরকারের

রাজ্য

উদয়নারায়ণপুরে ফাটল সেতুতে।

একনাগাড়ে তিনদিন দক্ষিণবঙ্গের চলতে থাকা বৃষ্টি ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনলো দক্ষিণবঙ্গে। কলকাতাসহ জেলাজুড়ে লাগাতার বৃষ্টিতে জনজীবনের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে চলেছে। কিছু জেলায় তৈরি হয়েছে বন্যা পরিস্থিতি। এই আবহে জেলা শাসকদের ছুটি বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যসচিব। বৃষ্টি পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে শনিবার দুপুরে জেলা শাসকদের নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠকে বসছিলেন মুখ্যসচিব। দক্ষিণবঙ্গের প্রত্যেক জেলায় নদীর জল বেড়ে চলায় বিশেষ করে উদ্বিগ্ন নবান্ন।

বীরভূমের ময়ূরাক্ষী নদীতে জল বেড়ে গিয়েছে। ময়ূরাক্ষী নদীর উপর সিউড়ির তিলপাড়া ব্যারেজ থেকে ৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়। প্লাবনের আশঙ্কা রয়েছে। ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকায় কার্যত বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ঝাড়গ্রামের সুবর্ণরেখার নদীর জলস্তর এতটাই বেড়ে গেছে। তার জেরে সাঁকরাইল ও নয়াগ্রাম যাতায়াতের ফেয়ার ওয়েদার সেতু ভেসে গিয়েছে। কলকাতা বিমানবন্দর জলমগ্ন। অণ্ডাল বিমানবন্দরে সর্বত্র জল জমে যাওয়ায় বিমান ওঠানামা বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে ডিভিসি কর্তৃপক্ষের জল ছাড়া আরো চিন্তা বাড়াচ্ছে। ওই পরিস্থিতিতে ত্রাণ সামগ্রী ও অন্যান্য জরুরি ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।  

মাইথন জলাধার থেকে ১০,০০০ কিউসেক এবং পাঞ্চেত জলাধার থেকে ৭৫,০০০ কিউসেক জল ছেড়েছে ডিভিসি। দুই জলাধার থেকে শনিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত মোট ৮৫,০০০ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। ফের দামোদর ভ্যালি রিভার রেগুলেটেড কমিটি আরো জল ছাড়ার কথা জানাতেই চিন্তায় পড়েছে নবান্ন। কেননা ডিভিসি থেকে জল ১ লক্ষ কিউসেক ছাড়া হলে তা বাংলার মানুষের জন্য বিপজ্জনক হবে রাজ্য সরকারের তরফে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে গন্ধেশ্বরী, দ্বারকেশ্বর, শিলাবতী, কংসাবতী সহ প্রত্যেক জেলায় একাধিক নদীর জলস্তর ফুঁসতে শুরু করেছে। এর ফলে দুই মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, নদিয়া, হুগলি এবং বর্ধমানের একাধিক এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। 

বানভাসী পরিস্থিতিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলিতে কন্ট্রোল রুম খোলা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জলমগ্ন এলাকায় নামানো হয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকে। মালদায় বৃষ্টিতে কোথাও হাঁটু, কোথাও কোথাও কোমর সমান জল। বেহাল নিকাশির জেরে কার্যত ঘরবন্দি মানুষ। জলে ডুবে গিয়েছে এলাকার রাস্তাঘাট। এই ছবি মালদার হবিবপুরের আইহো পঞ্চায়েতের বক্সিনগর, বিবেকানন্দপল্লী, ভরপাড়া সহ বিভিন্ন এলাকায়। চরম দুর্ভোগকে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। মানুষজনের বাজারহাট, চিকিৎসা, স্কুল, কলেজ যাতায়াত সবই বন্ধ। তা না হলে করতে হচ্ছে জল ভেঙে। এমনকী পানীয় জলের কল পর্যন্ত জলের তলায়। তাই খাবার জল সংগ্রহ করতে চরম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। টানা বৃষ্টিতে ঘাটাল ব্লকের ঝুমি নদীতে জল বেড়েছে। ঘাটালের এসডিও সুমন বিশ্বাস শনিবার এলাকা পরিদর্শন যান। পরে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বলেন, ‘‘আমরা প্রত্যেকদিন জলের ওয়াটার লেভেল পাই। এখনও পর্যন্ত বিপদ সীমার নিচে জল বইছে। নদীর উপর বাঁশের সাঁকোগুলি ভেঙে গিয়েছে। পরিস্থিতির দিকে নজর রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’ 

এক নাগাড়ে বৃষ্টি আর অন্যদিকে খাল মজে যাওয়ার জেরে জমা জল বের হতে পারছে না বলে আগেই আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল জেলা প্রশাসন। এর জেরেই রাস্তাঘাট, মাঠ ভেসেই চলছে। টানা বৃষ্টিতে পুরানো বাড়ি দুর্বল হয়ে নানা জায়গায় ভেঙে পড়ছে। প্লাবিত হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলার বিভিন্ন অঞ্চল। রাজ্যের একাধিক নদী জল বিপদসীমাকে পার করছে। জল মারাত্মক বেড় যাওয়ায় সেই জলই গ্রামকে গ্রাম ভাসিয়ে নিচ্ছে। ভরা নদীর ভাঙনের তলাতে দেখা যাচ্ছে একের পর এক বাড়ি। বর্ষা শেষ হতে এখনো বাকি আছে।

এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় রাজ্যের সেচ দপ্তর ব্যবস্থা নিতে শুরু করল। নবান্ন সূত্রে জানা গেছে, অতি বৃষ্টির কারণে ছোট নদী এবং খালগুলি জলমগ্ন হওয়ায় সেখানে পলি জমে যাচ্ছে। সেই মজে যাওয়া খালের সঙ্গে কিছু নদীকে দ্রুত সংস্কার করতে না পারলে বাকি বর্ষায় পরিস্থিতি আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। আর সেই দিকে তাকিয়ে শেষকালে নদী-খাল সংস্কারের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে রাজ্যের সেচ দপ্তর। নবান্ন সূত্রে জানা গেছে,  জেলায় জেলায় খাল এবং মজা নদীকে চিহ্নিত করতে জেলা শাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন সেচ দপ্তরের সচিব প্রভাত মিশ্র।  

প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গে ৩৭,৬৬০ বর্গ কিলোমিটার বন্যা প্রবণ এলাকা রয়েছে ১১১টি ব্লকে। সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত কয়েক দশকের মধ্যে বন্যায় বেশ কয়েকবার প্রভাবিত হয়েছে ২০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। সাধারণত বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ এবং নদী সংস্কারের কাজ, নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি, জলাধারে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা, বহুমুখী জলাধার নির্মাণ করা দীর্ঘদিনের কাজ। ‘জল ধর, জল ভরো’ কর্মসূচিতে জেলায় জেলায় খাতা কলমে লক্ষাধিক পুকুর কাটা হলেও বাস্তবে তা যে হয়নি, তা দুই দিনের বর্ষা দেখিয়ে দিয়েছে।  

টানা বৃষ্টিতে শুক্রবার রাত থেকে জলমগ্ন কলকাতা বিমানবন্দর। রিপোর্ট অনুযায়ী, বিমানবন্দরের পার্কিং রাস্তায় জল জমে আছে। সারা রাত এবং ভোরের দিকে বৃষ্টির জেরে শনিবারে পরিস্থিতি একই ছিল। আশার কথা এদিন দমদম বিমানবন্দরের রানওয়েতে কোনও জল ছিল না। এই আবহে কলকাতা থেকে বিমান পরিষেবা আপাতত অব্যাহত আছে। শনিবার সকাল থেকে কলকাতা বিমানবন্দরের জলমগ্ন পরিস্থিতির ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে সোশাল মিডিয়ায়। ভিডিও’তে দেখা যাচ্ছে পরপর দাঁড়িয়ে আছে এয়ার ইন্ডিয়া থেকে ইন্ডিগোর বিমান। একটি গাড়ি সেখান দিয়ে যাচ্ছে, আর তাতেই ঢেউ গিয়ে পড়ছে বিমানের চাকায়।  

বৃষ্টিতে পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুর জলমগ্ন হয়েছে। শুক্রবারেই অণ্ডাল বিমানবন্দর ডুবে গিয়েছিল। এসবের জেরে ব্যাহত সেখানকার বিমান পরিষেবা। বাতিল হয় বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ ও দিল্লির তিনটি উড়ান। দেশের একমাত্র বে-সরকারি বিমাননগরী কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জলের কারণে তিনটি বিমান ওড়ানো সম্ভব হয়নি। এই আবহে কাজী নজরুল ইসলাম বিমানবন্দরের নিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অণ্ডাল বিমানবন্দরের যে সব ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসে, তাতে দেখা যাচ্ছে, বিমানবন্দরের রানওয়ের পাশাপাশি লাউঞ্জ থেকে টিকিট ঘর, লাগেজ বেল্ট থেকে ভিআইপি রুম, সবকিছুই জলে ডুবে গিয়েছে।  

গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের ওপরে অবস্থানরত ঘূর্ণাবর্তটি শুক্রবার শক্তি বাড়িয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। শনিবার সকালে সেটি আরও শক্তি বাড়িয়ে পরিণত হয়েছে গভীর নিম্নচাপে। এই পরিস্থিতির জন্য এদিন সকাল হতে না হতেই কলকাতা ও শহরতলীর বিভিন্ন জায়গার আকাশ কালো করে ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছিল। আলিপুর হাওয়া অফিস জানাচ্ছে, শনিবার সারাদিন কলকাতার আকাশ মেঘলা থাকলেও রবিবার থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে রাজারহাট, চিনার পার্ক সহ শহরতলির বেশ কিছু জায়গায় রাস্তায় জল জমে গিয়েছে। একই ছবি দক্ষিণের জেলাগুলিতেও। বীরভূমের কঙ্কালীতলায় শুক্রবার থেকেই জল জমে রয়েছে। জল জমেছে পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া শহরের একাধিক ওয়ার্ডেও। কঙ্কালীতলা মন্দির চত্বরে হাঁটুসমান জল জমে গিয়েছে। 

কলকাতা সংলগ্ন পাতিপুকুর আন্ডারপাসেও জল জমেছে। টানা বর্ষণের দুর্ভোগের ছবি ধরা পড়েছে রাজ্যের আরও অন্যান্য জায়গাতেও। শেষ ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে দমদমে। শনিবার সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত দমদমে বৃষ্টি হয়েছে ১০০ মিলিমিটার। তার পরই রয়েছে সল্টলেক। সেখানে বৃষ্টি হয়েছে ৮১.১ মিলিমিটার। কলকাতার আলিপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৩১.৯ মিলিমিটার। আসানসোল ও পুরুলিয়াতে যথাক্রমে ৭৫.৬ মিলিমিটার ও ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে মালদহে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৫৯.১ মিলিমিটার। বহরমপুরে বৃষ্টি হয়েছে ৫১ মিলিমিটার। এক নাগাড়ে বৃষ্টি শহরাঞ্চলে ভোগান্তি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের কপালে ভাঁজ ফেলা শুরু করেছে। দক্ষিণবঙ্গের বেশিরভাগ জেলার চাষের জমি এখন জলের তলায় চলে গেছে। এর মধ্যে একটাই আশা টানা বৃষ্টিতে শনিবার বিকালের পর ছেদ পড়েছে।   

Comments :0

Login to leave a comment