LF law Hospital

হাসপাতালে হামলা রুখতে আইন বামফ্রন্টের আমলেই, ঠুঁটো করে রেখেছে তৃণমূল সরকার

রাজ্য

সাত বছরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে নথিভুক্ত ৫০০’র বেশি ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছেন চিকিৎসক, নার্স থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা। চিকিৎসক সংগঠনগুলির বক্তব্য, থানায় অভিযোগের বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা হিসাব ধরলে দেড় হাজার ছাড়িয়ে যাবে। 
২০১৭ সালের পর থেকে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর হামলার তথ্য নথিভুক্ত করছে চিকিৎসক সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম। তাদের তথ্য বলছে, ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৩০০’র বেশি হামলা হয়েছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে কোভিড পর্বে হামলার ঘটনা বন্ধ ছিল। কিন্তু তারপর ২০২২ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত আরও ২০০’র বেশি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে চিকিৎসা ক্ষেত্রে। আইন থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টরস-এর নেতা ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামীর বক্তব্য, ‘‘চিকিৎসক সংগঠনগুলির মিলিত আন্দোলনে ২০০৯ সালে আইন তৈরি হয়েছিল। সেই আইনকে বর্তমান সরকার কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করলে হাসপাতালে নিগ্রহের ঘটনাকে লাগাম পরানো যেত। কিন্তু তা হয়নি।’’ 
গত শুক্রবার রাতে সাগর দত্ত হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর হামলার ঘটনা নতুন সংযোজন মাত্র। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে হামলা রুখতে গত ২০০৯ সালে আইন তৈরি হয়েছিল। মমতা ব্যানার্জির সরকারের আমলে এই আইনকে কার্যত ঠুঁটো করে রেখে দেওয়া হয়েছে। সরকারি আইন থাকার পরেও কেন চিকিৎসকদের উপর হামলা, তথ্য দিয়ে ২০২০ সালে কলকাতা হাইকোর্টে তা নিয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম। সেই মামলায় হাইকোর্টের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারকে বেশ কিছু নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারের তরফে মানা হয়নি একটি নির্দেশও।
চিকিৎসকদের উপর হামলার ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল, যে আইনে চিকিৎসক সহ স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছে, সেই আইনের কপি প্রত্যেক থানায় রাখতে হবে। উদ্দেশ্যে ছিল, হাসপাতালে ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় এফআইআর দায়ের করার সময়ে পুলিশ যাতে আইনের সাহায্য নিতে পারে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য দপ্তরে একজন নোডাল অফিসারকে নিয়োগ করার নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু কোনও নির্দেশই শেষ পর্যন্ত পালন করেনি রাজ্যের তৃণমূল সরকার।
চিকিৎসকদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম-এর যুগ্ম সম্পাদক রাজীব পাণ্ডে জানিয়েছেন, ‘‘চিকিৎসকদের উপর হামলার ঘটনায় রাজ্যের ২০০৯ সালের আইন কার্যকর না করার জন্যই আমরা আদালতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলাম। কিন্তু আদালতের কোনও নির্দেশই রাজ্য সরকার পালন করেনি।’’ 
এরাজ্যে হাসপাতাল ভাঙচুর থেকে শুরু করে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর আক্রমণ রুখতে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তৈরি হয়েছিল আইন। ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিকেয়ার সার্ভিস পার্সনস অ্যান্ড মেডিকেয়ার সার্ভিস ইনস্টিটিউশন (প্রিভেনশান অব ভায়োলেন্স অ্যান্ড ড্যামেজ টু প্রপার্টি) আইন ২০০৯ সালেই কার্যকর হয়ে যায়। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে ২০০৯ সালের আইনে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, মেডিক্যাল পড়ুয়া, প্যারামেডিক্যাল কর্মী, নার্সিং পড়ুয়া থেকে কর্মসূত্রে হাসপাতালে যুক্ত সবার জন্য রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হামলার ঘটনায় জামিন অযোগ্য ধারায় মামলার পাশাপাশি দোষী সাব্যস্ত হলে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায়ের বিধান রয়েছে সেই আইনে। 
২০০৯ সালের আইন প্রণয়নে মমতা ব্যানার্জির সরকার কার্যত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে এরাজ্যের সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে একের পর এক হাসপাতালে ঘটে গিয়েছে চিকিৎসক, নার্স থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। কেন সরকার আইনকে গত ১৪ বছরে কার্যকর করেনি?
সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকদের বক্তব্য, ‘‘সরকারি হাসপাতালে একের পর এক আক্রমণ, হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনায় যুক্ত থেকেছে শাসক দলের নেতা-কর্মীরাই। ফলে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। দিনের পর দিন রাজ্যে হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর হামলায় ছাড় পাওয়ার পর উৎসাহিত হয়ে বেড়েছে হামলা।’’ 
২০০৯ সালে ‘মেডিকেয়ার’ আইন তৈরি হওয়ার আগে চিকিৎসক সংগঠনগুলির দাবি মেনেই বামফ্রন্ট সরকার রক্ষাকবচের আইন তৈরি করেছিল। ওই সময়কালে রাজ্যে সরকারি ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি হামলায় আক্রান্ত হয়েছিলেন চিকিৎসকরা। মুর্শিদাবাদে এক চিকিৎসক খুন পর্যন্ত হয়েছিলেন। কর্মক্ষেত্রে আক্রমণ ঠেকাতে কড়া আইনের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেন চিকিৎসকরা। কলকাতায় মিছিল, সমাবেশের সঙ্গে রানি রাসমণি রোডে অবস্থান করে আইন প্রণয়নের দাবি জানায় চিকিৎসক সংগঠনগুলি। চিকিৎসক সংগঠনের দাবি মেনে রাজ্য বিধানসভায় বিল এনেছিল বামফ্রন্ট সরকার। সেই সময়ে বিলের বিরোধিতা করেছিল বিরোধী দলে থাকা তৃণমূল কংগ্রেস। বিল সিলেক্ট কমিটিতে যায়। সেখানে চিকিৎসক সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সংশোধনী প্রস্তাব আকারে জমা দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত বিলটি আইনে পরিণত হয়।

Comments :0

Login to leave a comment