একের পর এক তহবিল। এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবাধ যাতায়াত লগ্নি পুঁজির। তার সঙ্গে জড়িত আদানি গোষ্ঠীর অর্থ। দেশের বিধি ভেঙে চলেছে শেয়ার বাজারে কারচুপি। আদানি গোষ্ঠীর কারচুপির লগ্নি সংস্থাতেই টাকা রেখেছেন দেশের শেয়ার বাজারের নিয়ামক প্রতিষ্ঠান ‘সেবি’-র প্রধান নিজেই। সে কারণেই হচ্ছে না তদন্ত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লগ্নি সংস্থা হিন্ডেনবার্গের নতুন রিপোর্টে ‘সেবি’-র চেয়ারপার্সন মাধবী পুরী বুচ এবং তাঁর স্বামী ধবল বুচের টাকা লেনদেনের তথ্যও রাখা হয়েছে। দু’জনেই যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, ‘ভিত্তিহীন’, ‘চরিত্রহনন’ হয়েছে। তবে ‘সেবি’ প্রধানের পদ থেকে মাধবী পুরী বুচকে সরানোর দাবি জোরালো হয়েছে ফের।
এর আগে ২০২৩’র জানুয়ারিতে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে বোমা পড়েছিল ভারতের শেয়ার বাজারে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অতি ঘনিষ্ঠ আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দাম ৮০ শতাংশ বাড়ানো বলা হয়েছিল। এই গোষ্ঠীতেই বিপুল অঙ্কের শেয়ার রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থা এলআইসি’র। শেয়ার ছিল স্টেট ব্যাঙ্কেরও।
সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি বিবেচনায় আনলেও তদন্ত আটকে গিয়েছিল ‘আদানি গোষ্ঠীর লেনদেনে ‘সেবি’ সন্দেহজনক কিছু না পাওয়ায়। তদন্ত যদিও শেষ হয়নি। কিন্তু এগোয়নি’। ততদিনে সত্যিই আদানি গোষ্ঠীর একাধিক সংস্থায় শেয়ারের দাম প্রায় ৮০ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। অভিযোগ ছিল মরিশাসের মতো দেশে লগ্নি তহবিল খোলার। তারাই আবার ভারতের শেয়ার বাজারে আদানির শেয়ার কিনতে থাকায় দাম বেড়েছিল লাফিয়ে।
হিন্ডেনবার্গের নতুন রিপোর্টে তিনটি তথ্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রথমটিতে বলা হয়েছে, মরিশাসের ট্রাইডেন্ট ট্রাস্ট চালাতো গ্লোবাল ডায়নামিক অপারচুনিটিস ফান্ড। ২০১৭’র এপ্রিলে মাধবী পুরী বুচ ‘সেবি’-র সর্বসময়ের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন। তারপরও স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে তাঁর নামে এই সংস্থায় শেয়ার ছিল। ২০১৮’র ফেব্রুয়ারিতে শেয়ার বেচে টাকা ফেরতের জন্য চিঠি দেন। এই সংস্থায় আদানির যোগ রয়েছে।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২২’র মার্চে ‘সেবি’-র চেয়ারপার্সন হন মাধবী পুরী বুচ। ২০১৭’র এপ্রিল থেকেই তাঁর লগ্নি ছিল সিঙ্গাপুরের আগোরা পার্টনার্স নামে একটি আর্থিক লগ্নি পরামর্শদাতা সংস্থায়। চেয়ারপার্সন নিযুক্ত হওয়ার পরও কিছুদিন শেয়ার ছিল এই সংস্থায়। কিছু পরেই সব শেয়ার স্বামী ধবল বুচের নামে হস্তান্তর করেন তিনি। পরামর্শ দাতা সংস্থাটির আয়ের উৎস কী, কোথা থেকে লগ্নির প্রতিদান দিত এবং কাকেই বা পরামর্শ দিত- সেসব অস্পষ্ট বলে অভিযোগ হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে।
তৃতীয় অভিযোগ, আন্তর্জাতিক লগ্নি সংস্থা ব্ল্যাকস্টোন ধবল বুচকে পরামর্শদাতা নিয়োগ করে। অথচ তিনি ছিলেন ইউনিলিভার সংস্থায় পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ। কোনও লগ্নি সংস্থা বা রিয়েল এস্টেট সংস্থায় কাজই করেননি। কেন তা’হলে এই নিয়োগ?
হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে ব্যাখ্যা, আদানি গোষ্ঠীর বহু ব্যবসাকে কাজে লাগিয়ে টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ভারী যন্ত্রাংশ আমদানির খরচ দেখানো হয়েছে বাড়িয়ে। বাড়তি টাকা পাচার হয়েছে মরিশাস বা সিঙ্গাপুরে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন লগ্নি সংস্থায় এই গোষ্ঠীর টাকা লেনদেন হয়েছে দেশের আইনকে ফাঁকি দিয়ে। বলা হয়েছে, গোষ্ঠীর প্রধান গৌতম আদানিরই পরিবারের সদস্য বিনোদ আদানির নামে মরিশাসে আর্থিক লগ্নির তহবিল খোলা হয়েছে। মরিশাসকে বরাবরই এমন সন্দেহজনক লেনদেনের জন্য বেছে নেওয়া হয় সেদেশের আইনে ছাড় এবং ভারতের সঙ্গে চুক্তি থাকার জন্য। আদানি গোষ্ঠীও তাই করেছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘‘২০২৩-এ যে রিপোর্ট পেশ করা হয়েছিল তার তদন্ত করতে অনীহা দেখিয়ে গিয়েছে ‘সেবি’। মরিশাস এবং বিভিন্ন দেশে আদানির গোপন এবং ভুয়ো সংস্থার জাল ছড়িয়ে রয়েছে। তা খুঁজে দেখা হয়নি ১৮ মাস পরও। তার বদলে আমাদেরই ‘শো-কজ’ নোটিশ ধরিয়েছে ‘সেবি’।’’
বলা হয়েছে, ‘‘নথি দেখাচ্ছে আদানির সন্দেহজনক বিদেশি লগ্নি তহবিলে সেবি-র চেয়ারপার্সন এবং স্বামীরই শেয়ার রয়েছে। এই তহবিল খুলেই টাকা লেনদেন হয়েছে বিধি ভেঙে।’’
বুচকে এখনই ‘সেবি’-র চেয়ারপার্সন পদ থেকে সরিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটি গড়ে তদন্তের দাবি তুলেছেন সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়োচুরি।
Comments :0