বিশ্বকাপের জন্য তৈরি কাতারের বেশ কয়েকটি স্টেডিয়ামই বিশ্বকাপের পরে আর স্টেডিয়াম থাকবে না। লুসাইল স্টেডিয়ামের পরিণতি কী, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ফুটবলের ইতিহাসে এই স্টেডিয়ামের নাম উচ্চারিত হতে থাকবে। হয় লিওনেল মেসি এখানে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন বলে, অথবা এইখানে ফ্রান্স পরপর দু’বার বিশ্বকাপ জিতেছিল বলে।
বিশ্বকাপের কোনও ফাইনালই এভাবে আবর্তিত হয়নি একজনকে ঘিরে। আর্জেন্টিনা নয়, প্রশ্ন যেন মেসি জিতবেন কি না। এই প্রশ্ন এত স্পষ্ট, এত প্রবল যে ফাইনালের আগেও দু’দেশের কোচরাও তা অস্বীকার করতে পারেননি। ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশঁ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, আমি জানি মেসির হাতে কাপ যাক, চাইছেন চারদিকের মানুষ। আর্জেন্টিনার মানুষ, বিশ্বের অন্য প্রান্তের মানুষ, এমনকি অনেক ফরাসিও। আমি একলা। কিন্তু তাহলেও আমি লড়াই করব।
আর্জেন্টিনার কোচ স্কালোনি তো সাংবাদিক সম্মেলনে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। বস্তুত কান্নাভেজা গলায় বললেন, আমরা শুধু ট্রফি জিততে চাই। এই ম্যাচ দল ও দেশের কাছে বিরাট ম্যাচ কেননা লিও’র শেষ ম্যাচ।
আর্জেন্টিনার পক্ষে এই আবেগ যেমন উদ্দীপনার জন্ম দিতে পারে, তেমনই বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। স্নায়ুচাপ বাড়তে পারে। দেশের প্রাক্তন বিশ্বকাপজয়ী জর্জ ভালদানো শনিবার মন্তব্য করেছেন, ‘রবিবারের ফাইনালে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক ও তাঁর সতীর্থরা অনুরাগীদের মতো ফুটবলকে অনুভব করবে, প্লেয়ারের মতো ঘাম ঝরাবে।’ বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে এই অতি-অনুরাগের ফল নিয়ে শঙ্কা থাকছেই।
দুই কোচই স্বীকার করছেন না এই ফাইনাল মেসি-এমবাপে দ্বৈরথ। স্কালোনি বলেছেন, এইখেলা মেসি-এমবাপের লড়াইয়ের থেকে অনেক বেশি কিছু। এমবাপেকে থামাতে দলবদ্ধ উদ্যোগ প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফ্রান্স কেবল এমবাপে না। সমষ্টিগত ভালো ফুটবল খেলতেই হবে আমাদের। ওই দু’জন ছাড়াও উভয় দলেরই এমন প্লেয়াররা আছে যারা খেলা নির্ধারণ করে দিতে পারে। বিশ্বকাপের ফাইনালের পক্ষে এর চেয়ে ভালো দৃশ্য আর কী হতে পারে?
আর্জেন্টিনার পরিকল্পনা কী হবে, স্বভাবতই মুখ খোলেননি স্কালোনি। একটি বিকল্প হচ্ছে তিন ডিফেন্ডারকে রক্ষণে রেখে রাইট ব্যাক মোলিনাকে এমবাপের প্রহরী হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া। বিদ্যুৎ গতির এমবাপেকে আটকাতে গেলে মোলিনার উইং প্লে কঠিন। মেসির পাস থেকে গোলও করেছেন মোলিনা, কিন্তু রবিবার তাঁকে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। আরেকটি বিকল্প নিয়েও গুঞ্জন চলছে। এমবাপের বল পাওয়া বন্ধের জন্য চারজন মাঝমাঠের খেলোয়াড় নামানো। সেক্ষেত্রে ডি পল, ফার্নান্ডেজ, পারাদেস, ম্যাক আ্যালিস্টার একসঙ্গে নামবেন। আলোচনা চলছে ডি মারিয়াকে নিয়েও। তিনি নামলে ফ্রান্সের রক্ষণকে ব্যস্ত রাখতে পারবেন। মেসির সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়াও ভালো। তবে ধারণা করা হচ্ছে ডি মারিয়া শুরুতেই নামবেন না। সময় বুঝে তাঁকে খেলানো হবে। ফাইনাল-বিশেষজ্ঞ ডি মারিয়া কোপা আমেরিকার ফাইনালেও জয়ের গোল করেছিলেন।
আরো সতর্ক দেশঁ। তাঁর দলের প্লেয়ারদের অন্তত চারজনের ‘ফ্লু’ হয়েছে বলে খবর। সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করলে দেশঁ উত্তর দেন, আমি অনেক সকালে বেরিয়ে এসেছি, শেষ খবর জানি না। প্লেয়াররা তখন ঘুমোচ্ছিল। রাবিও, উপামেকানো, ভারানে, কোনাতে সুস্থ কিনা, তা-ও বলতে চাননি দেশঁ। দলের অধিনায়ক হুগো লরিসের মুখেও কুলুপ। আসলে, কে খেলবেন তা জানাতেই চায় না ফ্রান্স শিবির। বিপক্ষকে কোনো পরিকল্পনা করার সুযোগই দেবে না।
সাংবাদিকরা করিম বেঞ্জেমা নিয়েও প্রশ্ন করেছিলেন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দেশঁ বলেন, করিম আঘাত পেয়েছিল, লুকাস হার্নান্ডেজ প্রথম ম্যাচে আঘাত পায়। তখন থেকে দলে ২৪ জন খেলোয়াড় রয়েছে। প্লেয়ার, প্রাক্তন খেলোয়াড়, আহত খেলোয়াড়দের আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে আমি ভাবি না। রবিবার ফ্রান্সের ২৪ খেলোয়াড়ই গুরুত্বপূর্ণ।
একথা উভয় শিবিরই মানছে, ফারাক মেসিতে। এবারের মেসি যে বিস্ময়কর রকমের ক্ষুরধার, একথা প্রায় সর্বসম্মত। মেসি কেবল পাঁচটি গোলই করেননি, ছ’ম্যাচে চারটি গোলের পাস খেলেছেন। তার মধ্যে নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে মোলিনার গোলের পাসকেই এই বিশ্বকাপের সেরা পাস বলে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। ৩৫ বছরে শারীরিক সক্ষমতার কিছু ঘাটতি থাকেই। দেখা যাচ্ছে, মেসি সেইমতোই সাজিয়ে নিয়েছেন নিজের খেলার ধরন। অযথা দৌড়চ্ছে না, অপেক্ষা করছেন কখন গতি বাড়ানো যাবে, কখন গোলমুখ খোলা যাবে। তবে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে জয়ের জন্য তাঁর ক্ষুধা। গোটা দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রত্যক্ষতই। আর্জেন্টিনা দলও মেসির জন্য মরিয়া হয়ে খেলছে।
ক্লাব সতীর্থ এমবাপে পাল্লা দিচ্ছেন। মেসি যেমন আচম্বিতে কিছু অভাবনীয় ঘটিয়ে দিতে পারেন, এমবাপে তেমনই শুধু দৌড়েই ক্লান্ত করে দিতে পারেন গোটা বিপক্ষকে। মায়াজাল তৈরি করতে পারেন এমন এক জাদুকর বনাম অক্লান্ত এক সৈনিকের লড়াইয়ে বিশ্বকাপ চলে যাবে বুয়েনস আয়ার্স অথবা প্যারিসে।
Comments :0