Nandigram Panchayat poll

লালে সাজা নন্দীগ্রামে তৃণমূলের খড়কুটো সেই শুভেন্দুই

জেলা

সাদা কাগজে লাল বর্ডারের পোস্টার। বড় নয়। মাঝারি। তলায় খুদে খুদে অক্ষরে প্রিন্টার্স লাইনে ছাপানো ‘প্রচারে — সেখ মাসুদ করিম, সুকুমার বর্মণ, সেখ আতাউর রহমান, বাহারউদ্দিন খাঁন।’ পোস্টারের উপরের দিকে মাঝমাঝি স্লোগান লেখা —‘লুটের পঞ্চায়েত ভেঙে মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে তুলুন।’ তারপর তিন প্রার্থীর নাম, বড় করে আঁকা সিম্বল — কাস্তে হাতুড়ি তারা। পোস্টারের উপরের দিকে স্লোগানের দু’পাশে অত্যুৎসাহী যুবক প্রচারকরা দুজনের মুখ রেখেছেন — মহম্মদ সেলিম আর মীনাক্ষী মুখার্জি। 
কালিচরণপুর, গড়চক্রবেড়িয়া, বঙ্কিম মোড়ে এমনই পোস্টার সাঁটানো হয়েছে দেওয়ালে, তাল গাছের কাণ্ডে, পানীয় জল প্রকল্প না হওয়ায় রাস্তার ধারে অবহেলায় পড়ে থাকা নীল পাইপে, চায়ের দোকানের দেওয়ালে। 
প্রায় ১৫বছর পর এমন পোস্টার নিয়ে দিন রাত কাটাচ্ছে বঙ্কিম মোড়। 
যাঁরা নন্দীগ্রামের কথা জানেন, তাঁরা গড়চক্রবেড়িয়া, কালিচরণপুর, বঙ্কিম মোড়ের নাম জানেন। ২০০৭-র ৩ জানুয়ারি নন্দীগ্রামে শুরু হয়েছিল শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বাধীন তৃণমূলের রাস্তা কাটা, সেতু ভাঙার ‘আন্দোলন’, সেদিন প্রথম হামলা হয়েছিল কালিচরণপুরে। পঞ্চায়েত অফিসে। সরস্বতী বাজার থেকে বঙ্কিম মোড় পেরিয়ে ভুতার মোড়, গড়চক্রবেড়িয়া যাওয়ার রাস্তা ছিল মাওবাদী-তৃণমূলের সশস্ত্র হামলাকারীদের প্রধান রুট। সেই রুটে সিপিআই(এম)’র পোস্টার, ভোট দেওয়ার আহ্বান!
এই নন্দীগ্রাম দীর্ঘ অদেখার কারণে অচেনা।
সুফিয়ানের জাহাজ বাড়িতে তৃণমূলের বিরাট পতাকা উড়ছে। নতুন পতাকা — সদ্য টাঙানো। আর রাস্তায়? সিপিআই(এম)’র চেনফ্ল্যাগ অনেকটা এলাকাজুড়ে। সামসাবাদেও তাই। সেখানকার যুবকরা ছেয়ে দিয়েছেন এলাকা — লাল ঝান্ডায়।
এই নন্দীগ্রামের এক প্রার্থী সেখ মুস্তাফা। মহম্মদপুর আর ভেকুটিয়ার সীমান্তের বুথে বছর ৩৬-র মুস্তাফার গলায় লাল ওড়না। ওড়নার গায়ে পার্টির নির্বাচনী প্রতীক। পাশে পান বিড়ির দোকান। দোকানের গায়ে লেখা — ‘ভিডিও লাইব্রেরি।’ দোকানটি আগে তাই ছিল। এখন ভিডিও-র দিন গত। তাই তা পান, বিড়ির গুমটিতে রূপান্তরিত। দোকানের সামনে ফাঁকা জায়গাটুকুতে ছায়া এনে দিয়েছে টালির চাল। সেখানে দাঁড়িয়ে নন্দীগ্রামের অতীত এবং বর্তমান উঁচু স্বরে বলে যাচ্ছিলেন সেখ খুরশেদ। সাদা চুল। দাড়িতেও পাক ধরেছে। 
তার কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধের মেজো ছেলে মুস্তাফা বললেন,‘‘তৃণমূল চোর, দুর্নীতি করেছে কোটি কোটি টাকার। এ আর বলে বোঝাতে হচ্ছে না। লোকে ওদের উপর ক্ষিপ্ত। কিন্তু গন্ডগোল করছে বিজেপি। ওরা বলছে, ওদের ভোট না দিলে তৃণমূল জিতবে। আমার বুথে ৩০৫জন মুসলিম। ৬০০-র উপর হিন্দু। অনেকে কৃষক। তবে চাষ তো এখানে একবারই, তাই অনেকেই অন্য নানা কাজ করে। তাঁদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো। আমি নিজে গিয়ে তাঁদের বোঝাচ্ছি। বলছি, কাকু, জেঠি দেখো শুভেন্দুবাবুই এখানে তৃণমূলের মাথা ছিলেন। সুফিয়ান, তাহের আর শুভেন্দুর কোনও তফাত নেই। বিজেপি তৃণমূলকে আটকাতে চায় না। চাইলে এতদিনে অনেককিছু করত। তাই ভোট আমাকে দাও। আমাদের দাও। আমাদের জেতালে তৃণমূলকেও আটকাতে পারবে। শুভেন্দুবাবুকেও থামাতে পারবে।’’
নন্দীগ্রামে বিজেপি বলে কিছু নেই। ‘শুভেন্দুবাবু’ই বিজেপি। যাঁরা বিজেপি হয়েছেন, তাঁরা আসলে তৃণমূলী।
যেমন গোকুলনগরের স্বদেশ অধিকারী। তৃণমূলের দু’বারের পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ। ২০০৭-র মাওবাদী-তৃণমূল নৈরাজ্যে গোকুলনগরে তিনিই ছিলেন মাথা। সেই তিনি এবার গোকুলনগর থেকে বিজেপি’র পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী। তবে বড় উদাহরণ বিশ্বজিৎ মণ্ডল। নন্দীগ্রামে তৃণমূলের নেতা ছিলেন নিশিকান্ত মণ্ডল। মহাশ্বেতা দেবীর খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন এই তৃণমূল নেতা। মৃত সেই নিশিকান্ত মণ্ডলের ছেলে, তৃণমূলের দীর্ঘদিনের কর্মী এবার সোনাচূড়া থেকেই বিজেপি’র প্রার্থী। তিনি মুখোমুখি সিপিআই(এম) প্রার্থী চন্দ্রকান্ত পাইকের। আর সেই আসনে লড়ছেন গত তিনবার জেতা, তৃণমূল নেতা অজয় মণ্ডল। অজয়ের বড় অস্বস্তি।
কেন? সোনাচূড়ায় যখন চন্দ্রকান্ত এবং পার্টির কর্মীরা অটো প্রচার করছেন, দূরে এক জায়গায় বসে তৃণমূল প্রার্থী, প্রৌঢ় অজয় মণ্ডল বললেন,‘‘সিপিআই(এম)’র আরও জোরালোভাবে বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়া উচিত। এই পার্টির নেতা জ্যোতি বসু এদের বর্বর বলেছিলেন।’’ আহা! বিপন্ন তৃণমূল নেতার এখন জ্যোতি বসুকে মনে পড়েছে। কিন্তু আপনি এই কথা বলছেন কেন প্রচারে? দেখুন ‘আপনারা চোর’ এটা মানুষ জেনেছেন। এখন তৃণমূল বিরোধী সব মানুষকে এই কথা বোঝানোর চেষ্টা কেন করছেন যে, বিজেপি’র বিরুদ্ধে সিপিএম লড়ছে না। আপনারা লড়ছেন। এতে তো আপনাদের ‘চোর’ মনে করা মানুষ দলে দলে বিজেপি-কে ভোট দিয়ে দেবেন? ‘চোর’ কথাটি বিলকুল হজম করে নিলেন প্রৌঢ়। তৃণমূলের এই হয়েছে হাল। ‘চোর’ কথাটি মেনেই নিয়েছে। চিন্তিত, কিছুটা উত্তেজিত অজয় কার্যত যুক্তি হারিয়ে ফেললেন। বলে ফেললেন, ‘‘শুনুন, আমাদের যে ভোট চলে গেছিল, তার কিছুটা ফিরে এসেছে। আমরা বলছি মানুষকে আমরা থাকলে ভাতা পাবে। শুভেন্দুবাবু দু’বছরে আমাদের কী করতে পেরেছে? পেরেছে কিছু করতে? আমরা চিনেছি ওনাকে।’’
অঙ্ক সোজা — প্রথমত, ‘চোর’ প্রচারের তাড়া সামলাতে ঢাল করেছে ‘ভাতা’কে। তৃণমূল না থাকলে ক্ষমতায় নাকি ভাতা মিলবে না। সিপিআই(এম) নেতা পরিতোষ পট্টনায়েক বললেন,‘‘আমরাও বলছি। কোনওদিন কেউ শুনেছে যে, কোনও সরকার চলে গেলে ভাতা বন্ধ হয়ে যায়? আমরা চুরির টাকা উদ্ধার করব। তাই ভাতার পরিমাণও বাড়বে।’’ তৃণমূলের দ্বিতীয় অঙ্ক, গত দু’বছরে ‘শুভেন্দুবাবু’ তৃণমূলের কোনও নেতার কিছু করেনি। বিজেপি জিতলেও তৃণমূলের লাভ। তাই তৃণমূলই বোঝানোর চেষ্টা করছে বিজেপি-ই তাদের আসল শত্রু। সিপিআই(এম) জিতলে অজয় মণ্ডলদের অসুবিধা আছে। আর গ্রাম জাগছে লালা ঝান্ডার পক্ষে — টের পেয়েছে তৃণমূল।
প্রমাণ? মোর্তাজা।
টানটান চেহারা। দেখলে মনে হবে অ্যাথলিট। দেখা হলো বছর খানেক পরে। নমাজের সময় হয়ে এসেছে। মহম্মদপুরে মসজিদ, কবরস্থান আর মাদ্রাসা পাশাপাশি। সেখানেই রাস্তার পাশে মোর্তাজা বসেছিল কাঠের বেঞ্চে। তাঁকে ঘিরে, আশেপাশে জনা তিরিশ ছেলে। সব জোয়ান। এবার মোর্তাজা মহম্মদপুরে প্রার্থী। লাল ঝান্ডা সেই রাস্তায়, যে পথে একবছর আগে সিপিআই(এম)’র সমর্থকরাও বুঝেশুনে পা রাখতেন। কী খবর? মোর্তাজা বললেন,‘‘ঠিক আছে। দেখছেন তো কেমন সাজিয়েছি আমরা। দেওয়াল লিখেছি। ব্যানার, ফেস্টুন লাগিয়েছি। কয়েকজন আরও দেওয়াল লেখার লোক পেলে আরও ভালো হতো।’’
নন্দীগ্রাম এই বর্ষায় দেওয়াল লেখার লোক খুঁজেছে — মহম্মদপুরে, সামসাবাদে, কালিচরণপুরে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা, অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলা পার্টিনেতা মহাদেব ভুঁইয়া বললেন,‘‘আরও পোস্টার লাগবে বুঝলেন। লোকে চাইছে। বলছে, আরে আমাদের এখানে আরও পোস্টার পাঠাও। এত কী করে দিই বলুন তো?’’
এই নন্দীগ্রাম অদৃষ্টপূর্ব। এই নন্দীগ্রামকে চিনি না। 
 

Comments :0

Login to leave a comment