গল্প
শিক্ষালাভ
------------------------
সৌরীশ মিশ্র
------------------------
নতুনপাতা
দেবরাজবাবুর সেভেন বি-র ক্লাসে ঢুকতেই চোখে পড়ল তাঁর ক্লাসের সব ছাত্ররা ক্লাসের বাঁদিকের সারি দিয়ে রাখা বেঞ্চগুলোর মাঝামাঝি একটা জায়গায় জটলা করছে আর নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন নীচুস্বরে কথা বলছে। তবে যেই না দেবরাজবাবু ঢুকলেন রুমে সাথে সাথে সবাই তড়িঘড়ি এসে বসল নিজেদের জায়গায়। দেবরাজবাবু এই ক্লাসের ক্লাস টিচার। হাতের অ্যাটেনডেন্স খাতাটা, চক আর ডাস্টার টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললেন, "সবাই মিলে কি জটলা করছিলিস তোরা?"
"স্যার, সার্থক কাঁদছে তো, তাই ওকে কাঁদতে বারণ করছিলাম আমরা।" ছাত্রদের মধ্যে থেকে কে যেন একজন ডানদিকের বেঞ্চগুলোর পিছন থেকে বলে ওঠে।
"কাঁদছিল! কেন রে সার্থক কাঁদছিলিস কেন?" সার্থক বসেছিল যেখানে জটলাটা হচ্ছিল সেইখানেরই একটা বেঞ্চের কোনার সিটে। পায়ে পায়ে তার দিকে এগোতে এগোতে সার্থককে জিজ্ঞেস করেন দেবরাজবাবু।
সার্থক চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। দেবরাজবাবু দেখেন কেঁদে দু'চোখ লাল করে ফেলেছে সার্থক। ছেলেটাকে আগে একটু ধাতস্হ করা দরকার, মনে মনে ভাবেন দেবরাজবাবু। তাই তিনি বললেন, "সার্থক, তুই আগে একটু জল খা তো দেখি।"
স্কুলব্যাগ থেকে ওয়াটার বটল বের করতে ব্যাগটা সামনের টেবিলে তোলে সার্থক। তারপর ওয়াটার বটলটা বের করে সেটা থেকে খেতে থাকে জল।
"সার্থক একটু থিতু হোক, ততক্ষণ তোদের কাছ থেকে শুনি, কি কারণে কাঁদছিল ও।"
সাথে সাথেই বাঁদিকের সারির প্রথম বেঞ্চে বসা এই ক্লাসের মনিটর নবীন দাঁড়িয়ে উঠে বলতে শুরু করে, "স্যার, সার্থক প্রতি বছরের মতো এই বছরও স্কুলের অ্যানুয়াল ম্যাগাজিনের জন্য লেখা জমা দিয়েছিল। প্রতি বছরই তো ওর লেখা ছাপে। কিন্তু, আজ একটু আগে ও জানতে পেরেছে, ওর এবারের লেখাটা সিলেক্ট হয়নি। তাই..."
সবটাই এইবার পরিস্কার হয়ে যায় দেবরাজবাবুর কাছে। তিনি বুঝতে পারেন, ছেলেটা এক্সপেক্ট করেছিল তার লেখাটা ছাপবে, তাই অমনোনীত হওয়ার খবরে আঘাত পেয়েছে মনে। দেবরাজবাবু মনে মনে ভাবেন, ছেলেটার মনোবলটা চাঙ্গা করা দরকার। তাই তিনি সার্থকের দিকে সোজা তাকান এবার। সার্থক এরই মধ্যে জল খেয়ে অনেকটাই সামলে উঠেছে। "তুই এর জন্য কাঁদছিস?", সার্থককে বলতে শুরু করেন দেবরাজবাবু, "তুই ইংরেজি এই প্রোভার্বটা শুনিসনি- ফেইলিওরস আর দ্য পিলারস অফ সাকসেস? শোন্, জীবনে ফেইলিওর আসবেই আসবে। সব্বার আসে। তা বলে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। বরং সেই ফেইলিওরটা কেন হোলো সেটা বুঝে তারপর সঠিক পথে চলে হার্ড ওয়ার্ক করলেই সাকসেস তোর হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা দেবেই দেবে। তুই তো ভালোই লিখিস। তোর লেখা আমি পড়েছি আগে স্কুল ম্যাগাজিনে। তবে এবারের লেখাটা কেন সিলেক্টেড হোলো না, নিশ্চয়ই কোথাও খামতি থেকে গেছে, সেটা উদ্ধার করতে হবে তোকেই। তাছাড়া, এই ব্যাপারে তুই তো অলোকস্যারকে গিয়েও সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারিস। উনিই তো দেখেন ম্যাগাজিনের পুরোটাই। তাই কোথায় তোর খামতি রয়ে গেছে এবারের লেখার মধ্যে উনি যেমন বলে দিতে পারবেন তোকে, তেমনই তিনি বাতলেও দিতে পারবেন, এই খামতি ওভারকাম করার পথও, বুঝলি?" সার্থকের মাথায় একটু সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে এতোক্ষন টানা বলে একটু থামেন দেবরাজবাবু।
সার্থক মাথা নেড়ে ও যে বুঝেছে দেবরাজস্যারের কথা তা বোঝায়।
"তবে এই কথাগুলো যে এতোক্ষণ বললাম, তা সার্থককে উদ্দেশ্য করে বলেছি বটে, তবে বললাম কিন্তু তোদেরকেও।" ফের বলে ওঠেন দেবরাজবাবু, "কি তোরাও বুঝেছিস তো আমার কথা?"
"হ্যাঁ স্যার।" সমস্বরে বলে ওঠে গোটা ক্লাস। দেবরাজবাবুর চোখ এড়ায় না তার ক্লাসফ্রেন্ডদের সাথে যে গলা মিলিয়েছে সার্থকও।
Comments :0