কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারপতি নিয়োগ করা হলো দেশের আইন। তা দাঁতে দাঁত চেপে মেনে চলা উচিত। বৃহস্পতিবার কলেজিয়ামের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রের তাবড় তাবড় মন্ত্রী ও নেতাদের বিরোধিতায় এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দেশের শীর্ষ আদালত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা।
কলেজিয়ামের সুপারিশ সত্ত্বেও বিচারপতি নিয়োগে চলছে কেন্দ্রের ঢিলেমি। এই ঢিলেমির সময়ে কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারপতি নিয়োগে আপত্তি জানিয়েছেন খোদ আইন মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। দেশের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের ভাষণে কার্যত কলেজিয়াম পদ্ধতিতে আপত্তি জানিয়েছেন। বিচারপতিরা এদিন কেন্দ্রের তাবড় তাবড় মন্ত্রী-নেতাদের কলেজিয়ামের বিরুদ্ধে এই জাতীয় কথাবার্তাকে ‘ভালো ভাবে দেখছেন না’ বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কল, এ এস ওকা এবং বিক্রম নাথের বেঞ্চে এই সংক্রান্ত মামলার শুনানি চলছে। পরবর্তী শুনানি ৬ জানুয়ারি।
বর্তমান আইনে কলেজিয়ামের সুপারিশ মতোই হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ হয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় কলেজিয়াম বিচারপতিদের নাম স্থির করে তাঁদের নিয়োগের জন্য কেন্দ্রের কাছে সেই নামের তালিকা পাঠায়। কেন্দ্রের এতে কোনও আপত্তি থাকলে তা বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম দ্বিতীয় দফায় ফের সেই নাম সুপারিশ করলে তাঁদের নিয়োগ করতে কেন্দ্র বাধ্য। আইনত নাম সুপারিশের তিন মাসের মধ্যে নিয়োগ সেরে ফেলা উচিত কেন্দ্রের। কিন্তু বর্তমানে কলেজিয়ামের দুই দফায় সুপারিশ সত্ত্বেও ১১ জন বিচারপতির নিয়োগ দেড় বছরের উপর ঝুলে রয়েছে। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হয়েছে। এদিন মামলার শুনানিতে কলেজিয়ামের মাধ্যমে নিয়োগের পদ্ধতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রের আইন মন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতির বক্তব্য উল্লেখ করেন সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বরিষ্ঠ আইনজীবী বিকাশ সিং। তিনি বলেন, কলেজিয়ামের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগে কেন্দ্রের ঢিলেমি নিয়ে যে সময়ে আদালতে আলোচনা চলছে, সেই সময়ে কেন্দ্রের মন্ত্রী এবং উপরাষ্ট্রপতির মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কীভাবে এই নিয়োগ সংক্রান্ত আইনের বিরুদ্ধে কথা বলেন? তারই জবাবে বিচারপতি বিক্রম নাথ অ্যাটর্নি জেনারেল আর ভেঙ্কটরামানির উদ্দেশে বলেন, ‘‘সিং মন্ত্রী এবং উপরাষ্ট্রপতির কলেজিয়াম নিয়ে যে বক্তব্য উল্লেখ করেছেন, তা আমরা ভালভাবে নিচ্ছি না। তা খুব খারাপ নিদর্শন।
সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম নিয়ে তাঁদের এই বক্তব্য ভালো নয়। আপনি তাঁদেরকে পরামর্শ দিয়ে বলবেন, এই জাতীয় বক্তব্য থেকে তাঁরা যেন বিরত থাকেন।’’ বিচারপতি কল বলেন, ‘‘বর্তমানে কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারপতি নিয়োগ করা হলো দেশের আইন। তা আমাদের দাঁতে দাঁত চেপে মেনে চলা উচিত।’’
এদিকে কলেজিয়ামের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কেন্দ্র কীভাবে দেশের শীর্ষ আদালতের সঙ্গে একটা সংঘাতের আবহ তৈরি করছে, তা স্পষ্ট হয়েছে বিচারপতিদের বক্তব্যে। বিচারপতি কল এদিন এই পদ্ধতিতে নিয়োগে কেন্দ্রের আপত্তি প্রসঙ্গে বলেন, কত দিন এরকম পিংপং বলা খেলা চলবে? এর পরে তিনি বলেন, ‘‘যত দিন কলেজিয়াম পদ্ধতিতে নিয়োগে আইন থাকবে, তত দিন তা মেনে চলতে হবে। আমাদের এই আইন প্রয়োগ করতেই হবে। আপনি এই বিষয়ে সংসদে আলাদা আইন আনতে পারেন। আপনাকে কেউ নতুন আইন আনা আটকাতে যাবে না। কিন্তু যত দিন বর্তমান আইন রয়েছে, তা প্রয়োগ করতেই হবে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সমাজের কোনও একটি অংশ যদি বলতে থাকে, আমরা এই আইন মানব, আর ওই আইন মানব না— তাহলে তো বিচারব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। শেষে আমরা এটাই বলতে চাই যে, সংসদ আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু বিচারব্যবস্থা সেই আইন ঠিক মতো কার্যকর হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব পালন করে। তাই দেশের যে আইন রয়েছে, তা দাঁতে দাঁত চেপে মেনে চলতে হবে।’’
এদিকে গত ২৮ নভেম্বর এই মামলার শুনানিতে কলেজিয়ামের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগে কেন্দ্রের দীর্ঘ ঢিলেমিতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন বিচারপতিরা। তাঁরা বলেছিলেন, বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কলেজিয়াম নামের তালিকা সহ ফাইল পাঠালে কেন্দ্র তা চেপে রেখে দিচ্ছে। কেন্দ্র ফাইল ছাড়ছে না, তাই নিয়োগ হচ্ছে না। এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আইন মন্ত্রী কিরণ রিজিজু বিচারপতিদের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘‘ফাইলের উপর চেপে কেন্দ্র বসে আছে বলবেন না। যদি তাই মনে হয়, তবে ফাইল পাঠাবেন না কেন্দ্রের কাছে। আপনারা যা পারেন করে নিন।’’ এর পরেই কলেজিয়াম পদ্ধতির কড়া সমালোচনা করে রিজিজু বলেন, এই কলেজিয়াম পদ্ধতি অস্বচ্ছ। সংবিধানের সঙ্গে একদমই বেমানান। প্রসঙ্গত, মোদী সরকার কলেজিয়াম পদ্ধতিতে নিয়োগ বাতিল করে ২০১৫ সালে বিচারপতি নিয়োগে ন্যাশনাল জুডিসিয়াল কমিশন গঠনের আইন প্রণয়ন করে। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ তা খারিজ করে এবং কলেজিয়াম পদ্ধতিতে নিয়োগ বহাল রাখার নির্দেশ দেয়। অনেকেই মনে করেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বিচারপতি নিয়োগকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে এই কমিশন গঠন করে। এই কমিশন খারিজ করার নির্দেশেও ক্ষোভ জানান রিজিজু। সম্প্রতি রাজ্যসভায় উপরাষ্ট্রপতি ধনখড় একইভাবে জুডিসিয়াল কমিশন আইন সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করায় তাঁর আপত্তি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। সুপ্রিম কোর্টে আইন খারিজ হওয়ায় সংসদের স্বাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে বলেও তাঁর অভিযোগ ছিল। এদিনে শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট কার্যত কেন্দ্রের কলেজিয়াম-বিরোধী অবস্থানকে বর্তমানে আইন-বিরোধী অবস্থান বলেই বুঝিয়ে দিল।
Comments :0