প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতির টাকা সরাসরি ‘ডিল’ করতেন মানিক ভট্টাচার্য। সেই টাকার একটা বিপুল অংশ পৌঁছাতো শাসক তৃণমূলের একেবারে শীর্ষ মহলে, নির্দিষ্ট এক প্রভাবশালী তরুণ নেতার কাছে। নিয়োগ দুর্নীতির টাকা মানিক ভট্টাচার্যের হাত হয়ে গত বিধানসভা নির্বাচনেও তৃণমূলী দলীয় তহবিলে ঢুকেছিল। বিনিময়মূল্য হিসাবেই পরপর তিনটি প্রাইমারি টেটে বেনজির দুর্নীতির পরেও আদালতের হস্তক্ষেপের আগে পর্যন্ত মানিক ভট্টাচার্যকেই প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতির পদে বহাল রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
বুধবার আদালতেও চার্জশিট পেশের পরে কার্যত সেই ইঙ্গিত দিয়েই ইডি’র তরফে আইনজীবীরা বলেন, বিপুল পরিমাণ টাকা তোলা হয়েছিল এই নিয়োগ দুর্নীতির মাধ্যমে। মানিক ভট্টাচার্যের মাধ্যমে সেই টাকা পৌঁছাতো দলের উপরমহলেও। এসএসসি থেকে প্রাইমারিতে নিয়োগ দুর্নীতিতে বারবার আসছে সেই উপরমহলের প্রসঙ্গ। মানিক ভট্টাচার্যের উপরমহল কে? মানিক ভট্টাচার্য তৃণমূলের বিধায়ক। গ্রেপ্তারির পরে দু’মাস পেরিয়ে গিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত তৃণমূলের তরফে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পার্থ চ্যাটার্জির ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হলেও অনুব্রত মণ্ডল ও মানিক ভট্টাচার্যের প্রশ্নে শাসক তৃণমূল নীরব। কেন? একজন বিধায়ক, প্রাইমারি টেট কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত, জেলে রয়েছেন, হাজার হাজার মেধাবী চাকরিপ্রার্থীর ভবিষ্যৎ খুন করেছেন— তারপরেও মুখ্যমন্ত্রী সেই কীর্তিমান বিধায়ক নিয়ে চুপ কেন?
সব প্রশ্নের উত্তর আসলে একই। ‘দলের উপরমহলে টাকা জোগাতেন মানিক ভট্টাচার্য’।
রীতি মতো জেলায় জেলায় চক্র করে এই টাকা তুলতেন মানিক ভট্টাচার্য। চার্জশিটেও সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। টাকা দেওয়া অযোগ্য প্রার্থীদের নামের তালিকা আসার পরে তা পৌঁছাতো মানিক ভট্টাচার্যের কাছে। মেধা তালিকার বাইরে এই নামের তালিকা এরপর পাঠানো হতো মন্ত্রীর কাছে। এদিকে, তার আগেই মন্ত্রীর কাছে জমা হওয়া তৃণমূলের একাধিক শীর্ষ নেতার সুপারিশের ভিত্তিতে ঐ তালিকায় আবার সংযোজন, বিয়োজন হতো। এরপর চূড়ান্তভাবে তা পাঠানো হতো পর্ষদের অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের কাছে, যাতে মেধা তালিকা বদলে দ্বিতীয় তালিকায় সেই নাম থাকে। যাদের নাম থাকতো তাঁদের কাছ থেকে ততক্ষণে প্রার্থীপিছু ৮-১০ লক্ষ টাকা তোলা হয়ে গেছে।
প্রথম কয়েক বছর মানিক ভট্টাচার্যের হয়ে এই টাকা তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন বীরভূমের নলহাটি ২ নম্বর ব্লকের সভাপতি বিভাস অধিকারী। সেই সময়ে প্রাথমিক টেটে নিয়োগের তালিকাও নিয়ন্ত্রণ করতেন এই ব্যক্তি। টাকা উঠবে কোন জেলা থেকে, কত টাকা, সব হিসাব রাখা হতো। অনুব্রত মণ্ডলেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন এই ব্যক্তি। অনুব্রতর তরফেও গোছা গোছা সুপারিশ পৌঁছেছিল মানিক ভট্টাচার্যের কাছে। অল বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং অ্যাচিভার্স নামে তৃণমূলের মদতপুষ্ট সংগঠনের সভাপতি ছিলেন তিনি। এরপর তাঁর দুর্ঘটনার পরে সেই পদে বসানো হয় তৃণমূল ঘনিষ্ঠ শিক্ষাব্যবসায়ী তাপস মণ্ডলকে। এখনও পর্যন্ত তিনি ওই সংগঠনের সভাপতির পদে আছেন। তাপস মণ্ডল ইতিমধ্যে দু’দফায় ইডির জেরায় জানিয়েছেন বিএড, ডিএলএড কলেজের ছাত্রপিছু টাকা তুলে মানিক ভট্টাচার্যের অফিসে নিয়ম করে পাঠাতে হতো।
এরই মধ্যে এদিন ইডি’র তরফে টুইট করে জানানো হয়, মানিক ভট্টাচার্য, তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও ঘনিষ্ঠদের মোট ৬১টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিশ মিলেছে। তাতে পড়ে থাকা ৭ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা ইতিমধ্যেই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত এই প্রাইমারি টেট কেলেঙ্কারির মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তে মোট ১১১ কোটি টাকা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
বিশেষ করে, বিএড এবং ডিএলএড কলেজ থেকে যে বিপুল পরিমাণ টাকা তোলা হয়েছে, তার একটা বড় অংশ পৌঁছাতো সেই নির্দিষ্ট শীর্ষমহলে। সেই কারণেই মানিক ভট্টাচার্য নিয়ে মুখে কুলুপ শাসক তৃণমূলের। স্রেফ তিনটি শিক্ষাবর্ষে রাজ্যের সরকারি, বেসরকারি ডিএলএড কলেজ থেকেই ২৫ কোটি টাকার বেশি তুলেছেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি, তৃণমূলী বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য! টাকা তোলার এই কৌশল ও হিসাব দেখে তাজ্জব খোদ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র আধিকারিকরাও।
রাজ্যে ডিএলএড’র কলেজ আছে ৬৪৯টি, সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে। দু’বছরের কোর্স। মোট আসন সংখ্যা ৪৭ হাজার ৭০০।
তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র দাবি, এক্ষেত্রে যে সমস্ত পড়ুয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনলাইনে আবেদনে করতে পারেনি, তাদের ক্ষেত্রে অফলাইনে ভর্তির সময়েই এই টাকা তুলতেন মানিক ভট্টাচার্য। তদন্তকারী সংস্থার দাবি, ডিএলএড কলেজ পিছু গড়ে প্রায় ২৫ জন পড়ুয়া নির্ধারিত অনলাইনের সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরে অফলাইনে ভর্তি হতো। সেই ছাত্র পিছু ৫ হাজার টাকা করে তোলা দিতে হতো তৃণমূলী বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যকে। ৬৪৯টি কলেজ। গড়ে ২৫ জন ছাত্র হলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১৬ হাজার ২২৫। তিনটি শিক্ষাবর্ষে মূলত এই টাকা তোলা হয়েছে। ২০১৮-২০, ২০১৯-২১, ২০২০-২২। প্রতি শিক্ষাবর্ষে গড়ে ৮ কোটি টাকার বেশি। তিনটি শিক্ষাবর্ষে কেবল হবু শিক্ষকদের কাছ থেকেই মানিক ভট্টাচার্য ২৫ কোটি টাকার বেশি তুলেছিলেন।
ইতিমধ্যে আদালতে সেই তথ্য উল্লেখও করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। তদন্তকারী আধিকারিকদের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি শিক্ষাবর্ষে এই টাকার একটা বড় অংশের কোনও হিসাব নেই, সেই টাকা নগদেই পৌঁছে দেওয়া হতো প্রভাবশালী মহলে।
Comments :0