Editorial

লাদাখ সংকেত

সম্পাদকীয় বিভাগ

প্রকৃতির নিজের হাতে সাজানো লাদাখ দেশের অন্যতম শান্তির এলাকা। সেই শান্তিপূর্ণ লাদাখই জ্বলে উঠেছে অশান্তি আর হিংসার আগুনে। লাদাখের রাজধানী লে শহরে যুব সমাজের (সম্প্রতি যারা জেনারেশন জেড) প্রবল বিক্ষোভের জেরে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘাত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ প্রথমে টিয়ার গ্যাস এবং পরে সরাসরি গুলি চালায়। তাতে অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। জখম-আহতের সংখ্যা শতাধিক। এদের অনেকেই গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শান্তিপূর্ণ মিছিল, সমাবেশ লাদাখ বরাবর দেখে এসেছে কিন্তু সেটা এমন হিংসাত্মক হয়ে ওঠা সম্ভবত এটাই প্রথম। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো এই বিক্ষোভ-প্রতিবাদ ছিল মূলত অল্প বয়সি যুবকদের, যাদের বেশিরভাগই কর্মহীন বেকার। যুব সমাজের অংশগ্রহণে এমন বিক্ষোভ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সাম্প্রতিক নেপালের ঘটনাকে। সেখানে যুব সমাজের প্রবল বিক্ষোভের জেরে সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। মোদী জমানায় এমন অশান্তি চলছে মণিপুরে তিন বছর ধরে। সেখানেও নির্বাচিত বিজেপি সরকার ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন চালু করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। আরএসএস, বিজেপি’র সুবিধাবাদী নীতি এবং বিভাজনের রাজনীতি মণিপুরকে জাতিগত, ধর্মগত ও সংস্কৃতিগতভাবে কার্যত দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ডাবল ইঞ্জিনের অপদার্থতা এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী তিন বছর মণিপুর মুখী হননি। এখন লাদাখের ঘটনা মণিপুরের স্মৃতিকে উসকে দিচ্ছে। তাছাড়া নানা মহলে আলোচনায় আসছে জনরোষে শ্রীলঙ্কায় সরকার পতন এবং বাংলাদেশে সরকার পতনের ঘটনাও।
২০১৯ সালে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীরের বি‍‌শেষ সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেবার পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যকে দু’টুকরো করে দু’টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ গঠন করে মোদী সরকার। প্রাথমিকভাবে জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র অঞ্চল গঠনে লাদাখের মানুষ খুশিই হয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসনে তারা ক্রমশ উপলব্ধি করতে থাকেন লাদাখ শাসনে ও লাদাখের উন্নয়নে লাদাখবাসীর ভূমিকা কার্যত শূন্য হয়ে গেছে। রাজ্যপালের মাধ্যমে লাদাখ শাসিত হচ্ছে দিল্লি থেকে। আবার বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার চলে যাবার ফলে লাদাখের জমি, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের উপর লাদাখের মানুষের অধিকার বা নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। সেটা চলে যেতে বসেছে বেসরকারি কর্পোরেটের হাতে। বাইরের মানুষের আগমনে জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে। তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র হারিয়ে যাবার আশঙ্কায়। স্বাভাবিকভাবে দাবি ‍‌ওঠে লাদাখের প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষা, জনজাতির স্বাতন্ত্র্য সুরক্ষার। তারা দাবি তোলেন লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দিতে হবে। দিল্লি থেকে নয় লাদাখ রাজ্য পরিচালিত হবে লে থেকে, লাদাখের মানুষের নির্বাচিত সরকার দ্বারা। লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে জনজাতিদের সমাজ সংস্কৃতির ঐতিহ্য রক্ষা করা যায়। বেকারত্বের সঙ্কট সামাল দিতে পৃথক পাবলিক সার্ভিস করতে হবে। লে এবং কার্গিলের জন্য দু’টি লোকসভা কেন্দ্র করতে হবে। এই দাবিগুলিকেই সামনে রেখে লাদাখে আন্দোলন দানা বেঁধেছে, তীব্র হয়েছে। ছ’বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে তারা কার্যত হতাশা। সেই হতাশা থেকেই আন্দোলনে বেপরোয়া মনোভাবের প্রকাশ বলে মনে করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে।

Comments :0

Login to leave a comment