New Year special

পালটায় ক্যালেন্ডার, অধরাই থাকে আশা-আকাঙ্ক্ষা

রাজ্য

সমন্বয় ভট্টাচার্য: কলকাতা

ডিসেম্বরের শেষ, রাত ১১টা। রিকশার সিটের উপর দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চেয়ে বেড়াচ্ছেন আজফার। আসলে সওয়ারি খুঁজছেন। অবশেষে এক যাত্রীর সন্ধান মিলল। ‘ওষুধের দোকান যাবে?’ উত্তর এল, ‘যেখানে বলবেন যাব।’ সওয়ারি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কালকে তো ১ জানুয়ারি। তোমরা কি কেউ বসবে এখানে? রিকশা মিলবে তো?’ আজফার বলেন, ‘কে আসবে না বাবু তা জানি না, আমি তো ভোর ৬টার মধ্যে এখানে ঢুকব। না এলে খাব কি?’
যাদবপুর অঞ্চলের নবাগত রিকশাচালক আজফার। পেটের দায়ে অনেক কিছুর চেষ্টা করেছেন তিনি। কিছুতেই তেমন লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত এই পেশা। কিন্তু তৃণমূল আমলে নতুন রিকশাকে স্ট্যান্ডে দাঁড়াতে হলে ইউনিয়নে চাঁদা দিতে হয়, ২৫০০০ টাকা। যে টাকা দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর নেই। কাজেই স্ট্যান্ড থেকে বহু দূরে দাঁড়িয়ে সাওয়ারির খোঁজ করতে হয় তাঁকে। ফলে রোজগারও কম। আজ যা পেয়েছেন তাতে কালকের খরচ পোষাবে না। তাই কাল সকাল সকাল এসে পৌঁছাতে হবে তাঁকে, স্ট্যান্ডের রিকশার থেকেও আগে। নববর্ষ উপলক্ষে যদি কিছু বেশি রোজগার হয়। বাড়িতে তাঁর তিনটে ছেলে মেয়ে। নিজে কম খান, বছরের প্রথম দিনে ছেলেমেয়েদের তো পেট ভরাতেই হবে তাঁকে।
‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’— এই বছরটা আপনার সবচেয়ে ভালো কাটুক, সব স্বপ্ন পূরণ হোক...ইত্যাদি, ইত্যাদি— ফেসবুক, হোয়াটস্‌অ্যাপ সহ বিভিন্ন সোসাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এইরকম হাজারও বার্তা। বছর ঘুরল। কিন্তু কত স্বপ্ন রয়ে গেল স্বপ্নই। ক্যালেন্ডার পালটে গেল, কিন্তু মিটল না আশা আকাঙ্ষাপ ।


শনিবার রাত ১২টা বাজার অনেক আগেই যখন সিডনিতে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হচ্ছিল তখন এই শহরে, গ্রামে গঞ্জে পথঘাটের আনাচে কানাচে ছোট শিশু সন্তান বুকে চেপে ধরে অনেক মায়ের চোখেই বর্ষশেষে কিছু ভঙ্গুর স্বপ্ন ঘুরপাক খেয়ে গেল বারে বারেই। মধ্যরাতের উত্তাল উদ্দামতার ফাঁকে ফাঁকে কত অসুস্থ গরিব মানুষ বিনা চিকিৎসায় পড়ে রইলেন রাস্তায়। তাঁদের কাছে বছরের প্রথমে যা শেষেও তো তাই।
একদিকে যখন বিশ্বের তাবড় দেশগুলিতে চলছে বর্ষবরণ উৎসবের প্রতিযোগিতা, তখন সেই একই বিশ্বে দিন আনা দিন খাওয়া গরিব মানুষের আর্তি, বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের হাহাকার, যুদ্ধবিদ্ধস্তদের আর্ত চিৎকার, অত্যাচারিত পদদলিত শিশুদের আর্তনাদ, অসহায় ধর্ষিতাদের গোঙানি, সেই সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে সন্ত্রাসবাদী হানার শঙ্কা। ভয়, শঙ্কা, আশঙ্কা, না পাওয়ার যন্ত্রণা, বাঁচার স্বপ্ন, কঠিন লড়াই— সব মিলিয়েই শুরু হলো নতুন বছর ২০২৩। 
নতুন বছর এলেই কি কোটি কোটি টাকার আলোর উৎসবের রোশনাইয়ের কোলাহলে চাপা পড়ে শিশুর খিদের কান্না, একটু ওষুধের জন্য বয়স্ক মানুষের হাহাকার? হাতে টাকা পয়সা নেই, ঘরে অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা, মায়ের জন্য সামান্য ওষুধের সংস্থান পর্যন্ত করতে পারেননি এই কলকাতা শহরতলির এক প্রান্তের বাসিন্দা কমল গায়েন। চোখের সামনে দেখতে বাধ্য হয়েছেন, কেমন করে একবুক স্বপ্ন নিয়ে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন ওই দুটো মানুষ। তবুও আশা ছাড়েননি কমল, লড়ছেন প্রাণপণ। তাঁর মতো বহু মানুষ লড়ছেন নতুন স্বপ্নের আশায়। পার্ক স্ট্রিট, চৌরঙ্গীতে নতুন বছর আসে, তাকে ঘিরে কত কোলাহল, হইচই শুরু হয়— কিন্তু কই? এদিক ওদিকে পড়ে থাকা সেই অসহায় মানুষগুলির জীবনে তো কোনও পরিবর্তন আসে না! 


বছর ঘুরে যায়। নৈরাজ্য আর অনাচারের বিচার হয় না। তাই তো বছর শেষে ধর্ষিতা মৃত কন্যা সন্তানের স্মৃতি আঁকড়ে বসে থাকেন এক মা। নতুন বছরের কোলাহলে সে স্মৃতি কি মুছে যাবে? বছরের শেষ দিনেও নিদারুণ অভাবে আত্মঘাতী এক তাঁত শ্রমিকের খবর এসেছিল। ওইদিনই খবর এসেছিল বিনা কারণে থানার ভেতরে পুলিশের অকথ্য অত্যাচারের। সেই স্মৃতি কী নতুন বছরে আর থাকবে না? শাসক দলের আশা জাগানো প্রতিশ্রতির স্বপ্ন ভাঙছে মানুষের। প্রমাণ সামনেই রয়েছে। সিঙ্গুরের কারখানায় কাজ পাওয়া হলো না কেশব সাঁতরা, সুকুমার মালিকদের। শিক্ষকতার চাকরি অধরাই থেকে গেল সুবর্ণা মাইতি, রেহানা খাতুনদের। সারা মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে দু’বেলা দুটো ডালভাত পরিবারের জন্য জোগাড় করতে বছরের প্রথমেও যেমন কষ্ট করেছিলেন সাইকেল দোকান কর্মচারী বিনোদ নস্কর, বছরের শেষেও তাই। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে এত হইচই। কই তা তো কমল না এতুটুকুও? যেমন একশো দিনের কাজ বন্ধ হয়ে গেল সুবিমল নস্করের। কবে পাবেন তিনি কাজ, কেউ বলতে পারে না। নতুন বছরের নতুন নতুন গালভরা আশ্বাসের স্বপ্ন আর দেখেন না তাঁরা। তবে জানেন একটাই কথা— ‘আরও লড়তে হবে।’ 
রবিবার নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে পথে নেমেছেন মানুষ। ভিড় উপচে পড়ছে চারদিকে। চলছে শুভেচ্ছা বিনিময়। বছরের প্রথম দিনটি উদ্‌যাপনের জন্য ‘প্ল্যান প্রোগ্রাম’ কত আগে থেকেই। ক্লাব, হোটেল রেস্তোরাঁগুলিতে গান বাজনা-খাওয়া দাওয়ার এলাহি আয়োজনে মাতোয়ারা গোটা বিশ্বের মানুষ। তারই মাঝে কিছুটা খুশির ঝলক এসেছে জেরিনা বেগম, শেফালি ছেত্রী, স্বরূপদের মুখে। নানা রঙের ফুল, লজেন্স, চকলেট থেকে ঘরে তৈরি, আচার, পাঁপড় চুটিয়ে বিক্রি করতে পেরেছে চিড়িয়াখানার সামনে, মিলেনিয়াম পার্কে— এখানে ওখানে। ওই একরত্তিদের কাছে বছরের প্রথম দিনটির স্মৃতি অমলিন থাকবে সারা বছর।

Comments :0

Login to leave a comment