এই প্রশ্নগুলি তুলে দিনভর অবস্থান চলল আরজিকর হাসপাতালের সামনে। বস্তুত সারা রাজ্যই তোলপাড় হচ্ছে এই প্রশ্নে। চিকিৎসকরা বলছেন, পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে অত্যাচারের যে প্রমাণ মিলেছে তাতে কোনও একজন ঘটনায় জড়িত নয়। একজনকে গ্রেপ্তার করে দায় সারলে চলবে না। আর কারা ছিল, খুঁজে বের করতে হবে। প্রভাবশালী পরিবারের কেউ বা ডাক্তার কেউ থাকলেও রেয়াত করা যাবে না।
সোমবার সকাল থেকে হাসপাতালের উল্টোদিকে মঞ্চ বেঁধে অবস্থান শুরু করেন এসএফআই-ডিওয়াইএফআই এবং সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কর্মী সমর্থকরা। প্রথম থেকে পুলিশ অসহযোগিতা করে। মঞ্চ খুলে ফেলার চেষ্টা, মঞ্চ তৈরি করতে আসা ডেকরেটার্সের কর্মীদের গ্রেপ্তারির ভয় দেখানো, কোনও কিছুই বাদ রাখেনি কলকাতা পুলিশ। তারপরেও মঞ্চ তৈরি হয়, এবং অবস্থান শুরু করেন বামপন্থী ছাত্র-যুব মহিলারা।
অবস্থানে বক্তব্য রাখেন এসএফআই’র সর্বভারতীয় নেত্রী দীপ্সিতা ধর। তিনি বলেন, ‘‘কাকদ্বীপ থেকে শুরু করে কামদুনির নির্যাতনের ঘটনায় দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেনি রাজ্য প্রশাসন। পুলিশ আদালতে যথেষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেনি বলে কামদুনির আসামীরা জামিন পেয়ে গিয়েছে। আরজিকর কান্ডে সরকার যদি সত্যি চাইত অপরাধীদের শাস্তি হোক, তাহলে তড়িঘড়ি মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হল কেন?’’
প্রাক্তন পুলিশকর্তা ও চিকিৎসকরা বলছেন, ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার ক্ষেত্রে নির্যাতিতার দেহ থেকে বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। নির্যাতিতার শরীরে থাকা ধর্ষকদের দেহরস তদন্তকে অভাবনীয় ভাবে সাহায্য করে। একইসঙ্গে সময়মত পরীক্ষা হলে অপরাধীদের শরীরেও নির্যাতিতার দেহকোষ কিংবা অন্যান্য জৈব পদার্থের নমুনা পাওয়া যেতে বাধ্য। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সময় বড় বালাই। কয়েক ঘন্টার দেরি প্রমাণ লোপাট করে অপরাধীদের বাঁচতে সাহায্য করতে পারে। এর মধ্যেই কেটে গিয়েছে প্রায় চার দিন।
দীপ্সিতা ধরের প্রশ্ন, ‘‘তারপরেও কেন তড়িঘড়ি নির্যাতিতার মৃতদেহ দাহ করে দিয়ে সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে দিল পুলিশ? আর কত স্পষ্ট ভাবে পুলিশ বলবে যে তারা অপরাধীদের আড়াল করার কাজ করছে?’’
গোটা ঘটনায় যত সময় গড়াচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে প্রশাসনিক যোগসাজশের বিষয়টি। বিক্ষোভ সভা থেকে মহিলা নেত্রী দীপু দাস বলেন, ‘‘পুলিশ কেন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনছে না? কেন সম্ভাব্য সন্দেহভাজনের সংখ্যা নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে? কেন ঘটনাস্থলের আশেপাশে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ্যে আনা হচ্ছে না?’’
ইতিমধ্যেই আরজিকরের প্রিন্সিপাল এবং সুপারকে বদল করা হয়েছে। ঘটনার সময় নির্যাতিতা কেন একা ঘুমোচ্ছিলেন, এমন কদর্য প্রশ্ন করেছিলেন প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষ। তাঁকে আরজিকর থেকে সরিয়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল করা হয়েছে।
ঘটনাচক্রে সোমবার মুখ্যমন্ত্রী সন্দীপ ঘোষের সপক্ষে সওয়াল করে বলেছেন, ‘‘ওনাকে গালিগালাজ করা হচ্ছিল। আমাদের জানিয়েছিল। ওনার ও তো বাড়িতে বাচ্চারা রয়েছে। কাজ করতে চাইছিলেন না। আমরা তাই ওনাকে সরিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়েছি।’’
আরজিকর কান্ডে বিচারের দাবিতে ইতিমধ্যেই রাজ্যজুড়ে কর্মবিরতি শুরু করেছেন ডাক্তারি ও প্যারা-মেডিক্যাল পড়ুয়ারা। সোমবার আরজিকর হাসপাতালের সামনে পথ অবরোধ করেন তাঁরা। অবরোধ থেকে সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পড়ুয়াদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। যাতে এই ধরণের ঘটনা আর কোথাও না ঘটে।
এদিন সন্ধ্যাবেলা নাগরিক ও ছাত্র সমাজের তরফে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় থেকে আরজিকর অবধি মিছিল করা হয়। মিছিল থেকে বিচারের দাবি জানানো হয়। স্লোগানের পর স্লোগানে কলকাতা পুলিশের ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানায় নাগরিক ও ছাত্র সমাজ।
বিক্ষোভ অবস্থানে এসে বক্তব্য রাখেন ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষি মুখার্জি। সদ্য প্রাক্তন প্রিন্সিপালের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘‘ছাত্রীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে না পারলেও সরকারি হাসপাতালের ভিতরে বাউন্সার বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।’’
বিপুল চাপের মুখে কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, এই ঘটনার তদন্তকারী দল বা সিটের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। অভিজ্ঞ একাধিক আইপিএস অফিসারকে দলে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, আরজিকরের সহকারী সুপার ও ৭জন চিকিৎসককেও লালবাজারে ডেকে পাঠানো হয়েছে।
অপরদিকে পুলিশ জানিয়েছে, পোস্ট মর্টেমে নির্যাতিতার দেহের কোনও হাড় ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়নি। যদিও ঘটনার পরে নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া চিকিৎসকদের প্রতিনিধি দলের হাতে পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট তুলে দেন তাঁর পরিজনরা। সেখানে পেলভিক বোন ভাঙার উল্লেখ রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী।
ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, এই স্ববিরোধিতা স্পষ্ট করার আর কোনও সুযোগই রাখেনি কলকাতা পুলিশ। নির্যাতিতার পরিবারের প্রাথমিক বিহ্বলতার সুযোগ নিয়ে দেহ দাহ করিয়ে দেয় পুলিশ। তা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে পরিবারেরও। ফলে তদন্তের স্বার্থে নতুন করে ময়নাতদন্তেরও কোনও সুযোগ নেই। স্পষ্ট নয়, নির্যাতিতার দেহ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে দেহকোষ ও দেহরস সংগ্রহ করা হয়েছে কিনা।
প্রশাসনিক যন্ত্রের প্রমাণ লোপাটের এই তৎপরতায় প্রশ্ন উঠছেই, শাসকদলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এক বা একাধিক ব্যক্তি এই ঘটনায় জড়িত নয় তো? যার বা যাদের নাম সামনে এলে চূড়ান্ত সঙ্কটে পড়বে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার?
রাজ্যের নতুন স্বাস্থ্য অধিকর্তা হচ্ছেন দেবাশিস হালদার। যুগ্ম স্বাস্থ্য অধিকর্তা ছিলেন তিনি ।
উত্তর ২৪ পরগনার নির্বাচন আধিকারিক শুভাঞ্জন দাসকে রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব পদে নিয়োগ করা হয়েছে
Comments :0