বিশ্বনাথ সিংহ: রায়গঞ্জ
কারও মাতৃভাষা ছিল বাংলা। কারও ঊর্দু। কয়েকজন কথা বলতো হিন্দিতে। এমন ১৮৪জন ছাত্রীকে নিয়ে শুরু হয়েছিল উচ্চ প্রাথমিক স্কুলটি। ২০০৮-এ যখন রাজ্যজুড়ে বামফ্রন্ট সরকারকে সরাতে তৃণমূল, মাওবাদী, জামাত, বিজেপি সহ বিভিন্ন শক্তি এক হয়ে ‘লড়ছে’, তখন চাকুলিয়া ব্লকের স্কুলটির যাত্রা শুরু। নাম— কানকি বালিকা বিদ্যালয়।
সেই স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেছে ২০২৩-র নভেম্বরে। রাজ্য সরকার শিক্ষক দিতে পারেনি, চারজন শিক্ষক ছিলেন সর্বশেষ, তাঁরা বদলি হয়ে যেতে পেরেছিলেন মমতা ব্যানার্জির চালু করা ‘উৎসশ্রী’ পোর্টালের মাধ্যমে। রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী সত্যজিৎ বর্মণের বাড়ি এই জেলায়। তবু খোলেনি স্কুল, ব্যবস্থা হয়নি শিক্ষকের। এখন সেই স্কুল প্রাঙ্গনে গবাদী পশু ঘোরে। সাপও দেখা যায়। একই ভাবে চাকুলিয়া ব্লকের বালুরবাধ বালিকা বিদ্যালয় শিক্ষকবিহীন। এখন শুধুমাত্র একজন অতিথি শিক্ষক দিয়ে চলছে। ক্ষতি হয়েছে পিছিয়ে থাকা উত্তর দিনাজপুর জেলার ওই চাকুলিয়া ব্লকের গরিব পরিবারগুলির।
শুধু ওই দুটি স্কুলই নয়। বিজ্ঞান বিভাগের কোনও শিক্ষক নেই ইটাহার ব্লকের পাড়াহরিপুর হাইস্কুলে। অথচ নামে এটি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল। ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। স্থায়ী শিক্ষক আছেন ৯ জন। বিজ্ঞান বিভাগের পড়াশোনা এই স্কুলে বন্ধ গত দু’ বছর। স্কুলের পরিচালন কমিটির এক সদস্য, তৃণমূল কর্মীর কথায়,‘‘অনেক বার দলের নেতাদের বলেছি। বিধায়কদের বলেছি। মন্ত্রীকেও বলেছি। লাভ হয়নি।’’ এক ছবি চাকুলিয়া ব্লকের সৈয়দপুর বাঘনটলি হাইস্কুলে। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এক সময় উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান বিভাগ ছিল। গত দু’বছর সে পাট চুকেছে। এমন আরও স্কুল আছে জেলায়। কর্মীর অভাবে লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরি অনেকগুলি বন্ধ।
রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী সত্যজিৎ বর্মণ উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ ব্লকের বাসিন্দা। উত্তর দিনাজপুর জেলায় উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ৩৬২। তার প্রায় ৬১ শতাংশ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। শোচনীয় অবস্থা প্রাথমিক স্কুলগুলিতেও। জেলার ১৪৭২টি প্রাইমারি স্কুলের ৭০৯টি প্রধান শিক্ষকবিহীন। ৪২টি স্কুলে একজন মাত্র শিক্ষক।
কেমন চলছে পড়াশোনা, স্কুলগুলির পরিকাঠামোর অবস্থা কী—এমন নানা বিষয়ে নজরদারি করা স্কুল পরিদর্শদের কাজ। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে এই কাজে বিশেষ জোর দেওয়া হতো। এখন? স্কুলে স্কুলে পরিদর্শন বেশিরভাগ জায়গায় বন্ধ। কিছু জায়গায় অনিয়মিত। ১৭টা সার্কেলের জন্য পরিদর্শক আছেন ৯ জন। তাঁদেরও স্কুলে পাঠানো হয় না। স্কুলগুলিতে মিড ডে মিলের চাল, ক্লাসরুম বানানোর টাকা চুরির মতো তৃণমূলের যাবতীয় দুর্নীতির কথা প্রকাশ হয়ে পড়ুক চায় না প্রশাসন।
নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে কয়েক দফায় জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাছে ডেপুটেশন দেওয়ার পরেও প্রশাসনের কোন উদ্যোগ নেই। জেলার বড়ো সমস্যা শিক্ষকদের অসম বন্টন। উৎসশ্রী পোর্টালের মাধ্যমে অনেকের বদলি হয়েছেন। শিক্ষক কমেছে সীমান্তবর্তী কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামগুলির স্কুলে। ফলে ক্ষতি হচ্ছে গরিব পরিবারগুলির ছাত্রছাত্রীদের। গ্রামের স্কুলগুলি শিক্ষক স্বল্পতায় ভুগছে, অন্যদিকে শহরাঞ্চলের স্কুলগুলিতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শিক্ষক নিযুক্ত আছেন। গ্রামের স্কুলগুলির পরিকাঠামোর হাল খারাপ হয়েছে। জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের স্থায়ী চেয়ারম্যান নেই আজ বছর তিনেক পার হয়ে গেছে। সরকার দোদুল্যমানতায়।
কালিয়াগঞ্জ ব্লকের পচাকান্দর প্রাইমারি স্কুল। সব শিশুরা একদিন স্কুলে আসলে বসার জায়গা জোটে না। ঘরের অভাব। বাচ্চাদের খেলার মাঠে মিড ডে মিল খেতে হয়। কালিয়াগঞ্জের বড়াল প্রাইমারি স্কুলে সামান্য বৃষ্টি হলে ছাদ দিয়ে জল পরছে একই অবস্থা মুস্তাফানগর জুনিয়র বেসিক স্কুলে। বৃষ্টি হলে অলিখিত ছুটি রাখা হয়।
এদিকে ঘোড়ার লাগাম পড়ানোর মতো সরকারি নির্দেশিকা। আগামীতে পঞ্চম শ্রেণি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়েই কেবলমাত্র যুক্ত হবে। সরকারি নির্দেশিকা মান্যতা দিতে হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রেণিকক্ষের অপ্রতুলতা আছেই দ্বিতীয়ত গঞ্জ থেকে মফস্বল এলাকার বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক শিক্ষিকাগণের অভাব, তৃতীয়ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রধান শিক্ষক নিয়োগের অভাব।
Comments :0