DANGERS OF CHAT GPT

চ্যাট-বটে বিপদ কোথায়? কী বলছেন প্রযুক্তিবিদরা?

জাতীয় আন্তর্জাতিক

CHAT GPT CHAT BOT ARTIFICIAL INTELLIGENCE BENGALI NEWS

বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে চ্যাট জিপিটি। কী এই চ্যাট জিপিটি? সোজা কথায় বলতে গেলে এটি একটি চ্যাট-বট বা সফটওয়্যার। বলা হচ্ছে যে এই সফটওয়্যারের কাছে, সমস্ত প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। যে মানুষের মতো ভাবতে পারে, জটিল পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় বলে দিতে পারে। আসলে এটি ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে চালিত। 

মানুষের যাবতীয় বুদ্ধিমত্তা কী অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে? যন্ত্র কী ভেবে সিদ্ধান্তও নেবে জটিল সমস্যার? এ প্রশ্নের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে সামাজিক প্রভাবের সম্ভাব্য দিকও। ‘যান্ত্রিক বিপ্লবে’ গুরুতর সামাজিক সঙ্কটের শঙ্কা শোনা যাচ্ছে প্রযুক্তিবিদ মহল থেকেও। ভুয়ো খবর এবং ঘৃণা ভাষণ আরও মারাত্মক, আরও নিয়মিত হওয়ার শঙ্কাও বাতিল করছেন না প্রযুক্তিবিদরা। 

আমেরিকার ওপেন এআই নামের একটি প্রযুক্তি ল্যাবরেটারি ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর চ্যাট জিপিটিকে জনসমক্ষে নিয়ে আসে। এই চ্যাট জিপিটি চ্যাট-বটটি জিপিটি ৩.৫ এবং জিপিটি ৪ প্রযুক্তির উপর দাঁড়িয়ে নির্মিত। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী কিছুদিনের মধ্যেই সমস্ত ডিজিটাল সামগ্রীতে এই প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়ে যাবে। তারফলে কি হবে? ধরা যাক আপনার কোনও বিষয়ে কোনও তথ্য প্রয়োজন হল। এতদিন আমরা তারজন্য গুগল বাবাজীর সাহায্য নিতাম। কিন্তু আমাদের মোবাইল বা ট্যাবলেটে এই চ্যাট-বট থাকলে আর তার প্রয়োজন পড়বে না। আমরা চ্যাট-বটের কাছে জানতে চাইব সেই তথ্য, এবং সে ভাষার মাধ্যমে বা লিখিত চ্যাটের মাধ্যমে আমাদের সামনে সেই সংক্রান্ত তথ্য হাজির করবে। 

আরও সহজ করে বললে, আমাদের সবার ফোনে একটি করে ডিজিটাল সিধু জ্যাঠার আবির্ভাব ঘটবে, যাঁর কাছে সমস্ত বিষয়ে তথ্য রয়েছে। শুধুমাত্র তাঁকে জিজ্ঞেস করার অপেক্ষা।

ইতিমধ্যেই গুগলের ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রযুক্তি বা অ্যালেক্সার মাধ্যমে সেই ভবিষ্যতের আভাষ কিছুটা আমরা পেয়েছি। অর্থাৎ আগামী দিনে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এক ঝড় আছড়ে পড়তে চলেছে, যা আমাদের পরিচিত চারপাশকে অনেকটাই বদলে দেবে। কিন্তু সেই ঝড়ের চরিত্র কি হবে? প্রবল গ্রীষ্মের রাতে শান্তির একদমকা ঠান্ডা বাতাস? না ঘূর্ণিঝড় হয়ে চেনা পরিচিত সবকিছু লন্ড-ভন্ড করে চলে যাবে সে?

গুগল এবং অ্যালফাবেটের সিইও সুন্দর পিচাই বলছেন, ‘‘অদূর ভবিষ্যতে সমস্ত কোম্পানির সমস্ত প্রডাক্টে এই প্রযুক্তি প্রভাব পড়তে চলেছে।’’ আমেরিকান সংবাদমাধ্যম সিবিএসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পিচাইয়ের সতর্কবার্তা, ‘‘এই প্রযুক্তির ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং অগ্রগতি বাধা পেতে পারে।’’

তাঁর সংযোজন, মূলত লেখক, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, প্রযুক্তিবিদদের মতো পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ক্ষেত্রে বেশি সমস্যা দেখা দিতে পারে। চ্যাট-জিপিটি যাঁরা তৈরি করেছেন, সেই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরিও আগামী দিনে সুরক্ষিত নাও থাকতে পারে। 

সুন্দর পিচাইয়ের পাশাপাশি এই প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করতে রাজি নন সিংহভাগ প্রযুক্তিবিদ। তাঁদের মধ্যে টেসলা’র সিইও ইলন মাস্ক, কিংবা অ্যাপেলের প্রথম প্রজন্মের প্রযুক্তিবিদ স্টিভ ওজনিয়াকও রয়েছেন। মাস্ক, ওজনিয়াক সহ শতাধিক প্রযুক্তিবিদ চ্যাট-বট ল্যাবগুলিকে রিতিমত চিঠি দিয়ে দাবি করেছেন, জিপিটি ৪’র থেকে উন্নত  চ্যাট-বট সংক্রান্ত সমস্ত গবেষণা অবিলম্বে স্থগিত রাখা হোক। 

একইসঙ্গে তাঁদের দাবি, সমাজ এবং কর্মক্ষেত্রে নতুন এই প্রযুক্তির প্রভাব খতিয়ে দেখতে তৃতীয় কোনও পক্ষকে দিয়ে সমীক্ষা এবং গবেষণা চালানো হোক। তারপর ফের শুরু হোক গবেষণার কাজ।  এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলিকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ারও আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা। 

এই চিঠিতে সই না করলেও, পিচাইয়েরও দাবি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে খুব দ্রুত এবং সহজেই ভুয়ো খবর, ছবি এবং ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তিনি বলেন, ‘‘ নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ ছাড়া প্রযুক্তির বিস্তার সমাজের জন্য ক্ষতিকর। চ্যাট-বটের প্রভাবের ক্ষেত্রে এমন বহু জায়গা রয়েছে, যার সবটা আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। তাই এই প্রযুক্তি মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ থাকাটাই বাঞ্ছনীয়।’’

ইতিমধ্যেই ইতালি সরকার নিজেদের দেশে চ্যাট জিপিটি’র ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সবথেকে দক্ষিণপন্থী সরকার ইতালি চালাচ্ছে। তবে ভিন্ন রাজনৈতিক মেরুর বিভিন্ন শক্তিও মনে করছে যে নতুন এই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অন্তত নিয়ন্ত্রণটুকু থাকা দরকার। 

এই বিষয়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে কৃত্রিম প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ টবি ওয়ালশ জানিয়েছেন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়াকে সম্পূর্ণ ভাবে বুঝে ওঠার আগেই তাকে সাধারণ মানুষের তুলে দেওয়া হয়েছিল। তার ফল হয়েছিল ভয়াবহ। ভুয়ো খবর, ঘৃণার প্রচার বেড়ে গিয়েছে ব্যাপক হারে। একইসঙ্গে তথ্যের গোপনীয়তা, গণতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার  প্রভাব পড়েছে সমাজে। তাই চ্যাট-বটের ক্ষেত্রে একই ভুল করা চলবে না।’’ 

যদিও টবি ওয়ালশ বাকি প্রযুক্তিবিদদের মতো গবেষণা থামানোর আবেদন জানাতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই প্রযুক্তি নিয়ে যত বেশি সম্ভব গবেষণা করা প্রয়োজন। কিন্তু সাধারণ মানুষের হাতে নতুন প্রযুক্তি তুলে দেওয়ার আগে সরকারি বিধিনিষেধ থাকাও আবশ্যিক।’’

এই ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি, পশ্চিমের দেশগুলি কার্যত আগুণ নিয়ে খেলছে। কোনও রক্ষাকবচ ছাড়াই চ্যাট জিপিটি’র ‘অ্যাক্সেস’ পেয়েছেন সাধারণ মানুষ। ওপেন এআই, মাইক্রোসফটের মতো সংস্থাগুলি কার্যত প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সরকারও চুপ।

টবি ওয়ালশ জানিয়েছেন, ‘‘তুলনায় চীনের সরকার এই বিষয়ে রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করে সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করেছে।’’

এই প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নন্দিনী মুখার্জি জানাচ্ছেন, ‘‘চ্যাট জিপিটি কিংবা এই ধরণের প্রযুক্তি ইন্টারনেটের সাহায্যে যে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবে। এবার ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা ভুল তথ্য বাছাই করার ক্ষমতা চ্যাট বটের নেই। তাই এর মাধ্যমে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে পড়ার একটা বড় আশঙ্কা থেকেই যায়।’’

এরইসঙ্গে তিনি যোগ করেছেন, ‘‘আগামী দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে ‘রিপিটেটিভ’ কাজ, বা যেই কাজগুলিকে ফর্মুলায় ফেলা যায়, সেগুলি সব প্রযুক্তির হাতে চলে যাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, ওয়েবসাইট ডিজাইনিং, কোডিং কিংবা কল-সেন্টারের কাজ পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ার পথে। এরফলে বহু সংখ্যক মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। একথা ঠিক, যে প্রযুক্তির গতিরোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির ফলে যাঁরা কাজ হারালেন, তাঁদের ‘রিস্কিলিং’ বা নতুন কাজের উপযোগী করে তোলার দায়িত্ব কে নেবে?’’

নন্দিনী মুখার্জির সংযোজন, ‘‘প্রযুক্তির উন্নতির ফলে একঘেয়ে কাজ থেকে মানুষ মুক্তি পাবে এ কথা ঠিক। কিন্তু প্রযুক্তির সুফল যদি সমাজে সমান ভাবে বন্টন করা না হয়, তবে আর্থ-সামাজিক বিভেদ আরও তীব্র হতে বাধ্য। প্রযুক্তি কখনোই মুষ্টিমেয় মানুষের আরও ধনী হওয়ার যন্ত্র হতে পারে না।’’

Comments :0

Login to leave a comment