Adino virus

অ্যাডিনো প্রাণ কেড়ে নিলো আরও ৩ শিশুর

রাজ্য

অন্নপ্রাশনের আর বাকি ছিল মাত্র কয়েকটা দিন। চলছিল তোড়জোর, ভাবনা চিন্তা। তার আগেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো সেই ছোট্ট শিশুটির নিথর দেহ। হাসপাতাল চত্বরেই হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন অসহায় বাবা মা। সেখানে তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা ছিল না কারোরই। রবিবার সকালে কলকাতার বি সি রায় হাসপাতালের সেই মর্মান্তিক দৃশ্য আদৌ নবান্নের কাছে পৌঁছেছে কিনা সে উত্তরও নেই কারো কাছে। একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করে গত ২ মাস ধরে বারবার বৈঠক করেও শিশু মৃত্যু মিছিল চাপা দিতে পারেনি নবান্ন। রবিবার ৩টি শিশুর মৃত্যুর খবর মিলেছে। বিভিন্ন বেসরকারি সূত্রে গত ২ মাসে অ্যাডিনোর বাড়বাড়ন্তে শিশু মৃত্যু সংখ্যা অন্ততপক্ষে ১৩৫। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেহাল স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকেই দায়ী করেছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলি। এই শিশুটির ক্ষেত্রেও তাকে সাগর দত্ত হাসপাতাল থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু কেন? সেই একইভাবে সাগর দত্ত হাসপাতালের বেহাল পরিকাঠামোর দিকে বারবারই আঙ্গুল তুলেছেন সন্তানহারা অসহায় ওই পরিবার। অ্যাডিনো ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করলেও তেমন কোনও হেলদোল নেই রাজ্য সরকারের। আতঙ্কে ভুগছে অসংখ্য শিশুর পরিবার।
দক্ষিণেশ্বরের বাসিন্দা এই পরিবারের ৬ মাস বয়সি শিশুটি গত ২সপ্তাহ ধরেই ভুগছিল জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে। প্রথমে তাকে কামারহাটির কলেজ অব মেডিসিন অ্যান্ড সাগর দত্ত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা চলে শিশুটির। পরিবারের বক্তব্য, চিকিৎসকরা যথেষ্টই গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা করছিলেন ওখানে। কিন্তু হাসপাতালের অব্যবস্থা ও খারাপ যন্ত্রপাতি চিকিৎসায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরপর শিশুটিকে নিয়ে কলকাতার এসে বি সি রায় হাসপাতালে ভর্তি করেন তাঁরা। বি সি রায় হাসপাতালেও চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। রবিবার সকালে শিশুটির প্রাণহীন দেহ তুলে দেওয়া হয় পরিবারের হাতে। আগামী ১৮ মার্চ তার অন্নপ্রাশনের দিন স্থির হয়ে রয়েছে। সেই চরম মুহূর্তে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিশুটির বাবা মা। তাঁদের বক্তব্য, আগে যদি জানা যেত সাগর দত্ত হাসপাতালে যন্ত্রপাতি অকেজো রয়েছে তাহলে আরও আগেই হয়তো কলকাতায় চিকিৎসা করা যেত সন্তানকে। এভাবেই একের পর এক শিশু মৃত্যু ঘটেছে, পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে হাসপাতালগুলির বেহাল পরিকাঠামো নিয়ে। কিন্তু নবান্নের কানে তা পৌঁছায়নি। 
রবিবার কলকাতায় আরও ৩ শিশুর মৃত্যুর খবর মিলেছে। বি সি রায় হাসপাতালে হাড়োয়ার ১৪ মাসের একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে রবিবার সকালে। জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই তার চিকিৎসা চলছিল বলে জানা গিয়েছে। অন্যদিকে এই হাসপাতালেই রবিবার উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুরের বছর দেড়েকের একটি শিশু মারা গিয়েছে। পরিবারের সদস্যদের কথায়, হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছিল তাড়াতাড়িই ছুটি দেওয়া হবে শিশুটিকে। কিন্তু তার মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে গিয়েছে। রাজ্য জুড়ে গত ২ মাসে এতগুলি শিশু মৃত্যুর পরেও মুখ্যমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছেন ১৯টি শিশু মারা গিয়েছে। তারও ৭ দিন পরে রাজ্যের মুখ্যসচিব সেই একই অর্থাৎ ১৯টি শিশুর মৃত্যুর পরিসংখ্যান দিয়েছেন। করোনা বা ডেঙ্গুর মতোই অ্যাডিনো ভাইরাসের প্রকোপেও নবান্নকে দেখা গিয়েছে সেই একইরকমভাবে তথ্য গোপন করতে। প্রকৃতপক্ষে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ— প্রতিদিন অহরহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে ফুসফুস সংক্রমণে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে বিভিন্ন বেসরকারি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। অ্যাডিনো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, ছড়িয়েছে তীব্র আতঙ্ক। কিন্তু সরকারিভাবে তার কোনও পরিসংখ্যান তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে না।    
শনিবার নবান্নে ৮ সদস্যের একটি টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়েছে অ্যাডিনো মোকাবিলায়। তাতে বলা হয়েছে এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিং চলবে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে প্রশ্ন উঠেছে, এই টাস্ক ফোর্সে কোনও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞকে রাখা হয়নি কেন। রাজ্য প্রশাসন একদিকে বলছে অ্যাডিনো সংক্রমণ কমে এসেছে। অন্যদিকে জরুরি ভিত্তিতে টাস্কফোর্স  গঠন করেছে। রবিবার ছুটির দিনেও সেই টাস্কফোর্সের ভার্চুয়াল বৈঠক হয়েছে। সরকারি তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে রাজ্যে প্রায় ১১ হাজার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন কেস রয়েছে (যদিও বেসরকারি মতে এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ)। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেই  টাস্কফোর্সে কোনও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞই নেই! সরকারিভাবে বলা হয়েছে পর্যাপ্ত ক্রিটিক্যাল বেডের ব্যবস্থা, চিকিৎসার উপকরণের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবারগুলির অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলছে। তাঁরা আঙুল তুলছেন বেহাল চিকিৎসা পরিকাঠামোর দিকে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি চিকিৎসা পরিকাঠামোর ভরসায় না থেকে নিজেদের সতর্কতার ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে রাজ্যবাসীকে। শিশু বেশি অসুস্থ হওয়ার আগেই যতটা সম্ভব কাছাকাছি চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে শিশুকে।

Comments :0

Login to leave a comment