পুলিশের সাধ্য কি জনস্রোত আটকায়!
বৃহস্পতিবার কোচবিহার জেলা পরিষদ অভিযানে ব্যারিকেডকে দেশলাইয়ের বাক্সের মতো দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে এগিয়ে গেল বামপন্থীদের প্রতিবাদী মিছিল। পুলিশ আর কমব্যাট ফোর্স আছড়ে পড়া প্রতিবাদী জনস্রোতে ততক্ষণে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছে। সবই ঘটে গেল এক মুহূর্তে।
এদিন জেলা পরিষদ অভিযানে বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির পাশাপাশি সিপিআইএম(এল)’র কর্মীরাও যোগ দিয়েছিলেন। জেলা পরিষদ অভিযান ঠেকাতে জেলা পুলিশ সুপার ২৪ ঘন্টা আগে থেকে ব্লুপ্রিন্ট ছকেছিলেন! পুলিশকর্মীদের দিয়ে কীভাবে মিছিল রুখে দিতে হবে, বুধবারই তার পরিকল্পনা করেছিলেন। ব্যারিকেডের রাস্তার দু’ধারের বাড়িতে বসানো হয়েছিল ভিডিও ক্যামেরা।
এদিন মিছিল যখন এগচ্ছে, জেলা পরিষদ ভবনের রাস্তার দু’ধারের উঁচু বাড়ির ছাদে আর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাড়ির মহিলারা ভিডিও ছবি তুলেছেন লাল ঝান্ডার লড়াকু মিছিলের। গ্রিলের তালা খুলে কেউ কেউ সাংবাদিকদের ছবি তুলতে নিজেরাই ডেকে নিলেন বাড়ির ছাদে। আর যখন হুড়মুড়িয়ে প্রথম ব্যারিকেড ভেঙে ফেললেন বামফ্রন্ট কর্মীরা, তখন রাস্তার দু’ধারের বাড়ির ছাদে দাঁড়ানো মানুষজন কেউ কেউ হাততালি দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘‘ভাঙো, ভাঙো, সব ব্যারিকেড ভেঙে গুঁড়িয়ে দাও।’’ তাঁরাও যেন তাঁদের ক্ষোভ উগরে দিয়ে জানান দিলেন, ‘‘আমরা মিছিলে পা না মেলালেও রাজ্যের তৃণমূল সরকারের লাগাতার অন্যায়ে আমরাও ক্ষুব্ধ, আমরাও আছি তোমাদের সঙ্গেই। আর একদিনও এই তৃণমুল সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না।’’
এদিন জেলা পরিষদ অভিযানে প্রথম ব্যারিকেড যখন ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে, পুলিশ তখন পিছু হটে দ্বিতীয় ব্যারিকেডের পেছনে আশ্রয় নিয়েছে। যখন দ্বিতীয় ব্যারিকেড ভাঙতে উদ্যত বামকর্মীরা, তখন মিছিলের লেজ রাসমেলার মাঠের কাছে। জেলা পরিষদের সামনের বড় রাস্তা ততক্ষণে চলে গিয়েছে লাল ঝান্ডা হাতে গ্রাম থেকে আসা হাজার হাজার মানুষের দখলে। গুটিকতক পুলিশকর্মী বুঝেই উঠতে পারছিলেন না, প্রতিবাদী জনস্রোতকে কী করে ঠেকাবেন।
তখনই এগিয়ে এলেন জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক অনন্ত রায় ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। মাইকে ঘোষণা করলেন অনন্ত রায়, ‘‘চাইলে আজ আমাদের কর্মীরা এক লহমায় দ্বিতীয় ব্যারিকেড ভেঙে জেলা পরিষদ ভবনে পৌঁছে যেতে পারেন। আমরা সেটা করতে চাই না।‘‘ কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘‘আপনারা রাস্তার ওপর বসে পড়ুন। এখানেই আমরা অবস্থান বিক্ষোভ করব জেলা পরিষদের উন্নয়নের টাকা লুটের প্রতিবাদে। এদিন প্রতিবাদী জনস্রোত ব্যারিকেড ভাঙলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করার সাহস দেখায়নি।
এদিকে, ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড ভেঙে যখন জনস্রোত এগচ্ছে, তখন জেলা পরিষদের দপ্তরে ছিলেন না সভাধিপতি উমাকান্ত বর্মণ। অনুপস্থিত ছিলেন অধিকাংশ আধিকারিকরাও। জেলা পরিষদের সামনের এক দোকানদার জানালেন, মিছিল রাসমেলার মাঠের কাছে আসার আগেই অনেক আধিকারিক অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন।
এদিন ঘাসবাজার থেকে প্রতিবাদী জনস্রোত যখন সামনের দিকে এগোতে থাকে, তখনও পুলিশ আন্দাজ করতে পারেনি, ঠিক কত মানুষ শামিল হবেন এই মিছিলে। ঘাসবাজার থেকে মিছিল বের হওয়ার সময়ে যত মানুষ মিছিল শুরু করেছিলেন, শহরের বিভিন্ন পথ ঘুরে ৪৫ মিনিট পরে যখন মিছিল জেনকিন্স স্কুলের কাছে, তখন মিছিলের দৈর্ঘ্য দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে। প্রকৃত অর্থেই এদিন কোচবিহারের সব গ্রামীণ এলাকার রাস্তা যেন এসে মিশেছিল শহরের পথে। মিছিল থেকে যেমন স্লোগান ওঠে— ‘লুটেরামুক্ত পঞ্চায়েত গড়ো’, তেমনই ১০০ দিনের কাজের বকেয়া মজুরি ও ১০০ দিনের কাজ চালুর দাবিতে এবং আবাস প্রকল্প ও শৌচাগারের কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির বিরুদ্ধেও শহরের পথে গ্রামের মানুষ ছিলেন সোচ্চার।
এদিন জেলা পরিষদ ভবনের কাছেই অবস্থান ও বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে অনন্ত রায় বলেন, ‘‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, আমরা জেলা পরিষদ গায়ের জোরে দখল করতে আসিনি। পাঁচ বছর আগে গায়ের জোরে গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ দখল করে উন্নয়নের যে টাকা লুট হয়েছে, তার হিসেব চাই। এবারে লুটেরামুক্ত পঞ্চায়েত গড়া হবে, তৃণমুল জেনে রাখুক। পুলিশ দিয়ে মানুষের ক্ষোভ আটকে রাখা যাবে না। সব লুটের হিসেব হবে পঞ্চায়েত ভোটের পর। আজ বামফ্রন্ট জানান দিয়ে গেল, চোরদের পঞ্চায়েত নয়, আগামী ভোটে মানুষের পঞ্চায়েত গড়া হবে।’’
এদিনের সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম) নেতা তমসের আলি, ফরওয়ার্ড ব্লকের অক্ষয় ঠাকুর, সিপিআই’র পক্ষে পার্থপ্রতিম সরকার প্রমুখ।
Comments :0