Bangladesh Muktijuddho

মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা

জাতীয় আন্তর্জাতিক

হায়দার আকবর খান রনো
 

এই যুদ্ধ ছিল প্রধানত জনতার যুদ্ধ। বামপন্থীদের অংশগ্রহণ ছিল গৌরবজনক যদিও সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল আওয়ামী লীগের হাতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকলেও তার স্পিরিট যেন সমগ্র জনগণকে যুদ্ধের জন্য প্রেরণা যোগাত এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধকে একরৈখিকভাবে দেখা ভুল হবে। তার বৈচিত্রময় দিককে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারলেই ইতিহাসকে যথাযথভাবে তুলে ধরা সম্ভব।
এক.
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতে থাকলেও বামপন্থীদের ভূমিকাও ছিল বড় মাপের। এই কথা বুর্জোয়া পত্রিকা ও গবেষকরা প্রায়শ এড়িয়ে যান। এই ভূমিকার কিছুটা বিস্তারিত বিবরণও এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে দেয়া সম্ভব নয়। আমি অন্যত্র এ সম্পর্কে লিখেছি যা বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত চার খণ্ডে ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থে সংকলিত আছে। আমি এখানে কয়েকটি পয়েন্ট ছুঁয়ে যাব মাত্র।

দুই.
এই ভূমিকার কথা উল্লেখ করার আগে একটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া দরকার। ১৯৪৭ সালে তখনকার পূর্ব বাংলার যে মুসলিম জনগণ পাকিস্তানের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল তাদেরই সন্তানরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। এটা বিস্ময়কর মনে হলেও বাস্তব ঘটনা। ঘোর সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশ থেকে জনগণকে ক্রমাগত মুক্ত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে বামপন্থীদেরই ছিল প্রধান ভূমিকা। ১৯৪৮ সালেই পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভায় মাওলানা ভাসানী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের বিরুদ্ধ সোচ্চার হন এবং পূর্ব বাংলার জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেন। সেজন্য তাকে আইন পরিষদের সদস্যপদ থেকে অন্যায়ভাবে সরিয়ে দেয়া হয় এবং কারারুদ্ধ করা হয়। মাওলানা ভাসানী কমিউনিস্ট না হলেও এই দেশের বামধারার আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন কমিউনিস্টদের অকৃত্রিম বন্ধু। আজীবন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং শ্রমিক কৃষক মেহনতী মানুষের মুক্তি সংগ্রামের নেতা। তিনিই প্রথম অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূত্রপাত ঘটান। ভাসানীকে তাই নিউ ইয়র্ক টাইমস ‘রেড মাওলানা’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় আরেকজন প্রভাবশালী নেতা শহীদ সহরাওয়ার্দী স্বায়ত্তশাসনের তীব্র বিরোধিতা করার কারণে তা তখন খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি (সহরাওয়ার্দী একই সময় পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট, সিয়াটো ও সেন্টোতে পাকিস্তানের অন্তর্ভু্ক্তির সপক্ষেও অবস্থান নিয়েছিলেন)। এর ঠিক এক দশক পরে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি পেশ করলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় এক বিরাট উল্লম্ফন ঘটে। পরের ইতিহাস সকলের জানা। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেই আলোচনায় আমি যাচ্ছি না।

তিন.
বামপন্থীদের ভূমিকা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই পাকিস্তান আমলে আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান ও কর্মপন্থা আলোচনা হওয়া আবশ্যক। ১৯৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়। এক অংশ সোভিয়েতপন্থী এবং অপর অংশ চীনপন্থী বলে পরিচিত হয়। চীনপন্থী অংশটি পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে কয়েকটি টুকরায় বিভক্ত হয়। তবে তারা সকলেই প্রকাশ্যেই স্লোগান দিতেন, ‘শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধরো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’। অবশ্য তথাকথিত মস্কোমন্থী অংশটির অবস্থান ছিল ভিন্ন। ১৯৬৮ সালের সেই পার্টির কংগ্রেসে গৃহীত রিপোর্টে বলা হয়, “… বর্তমানে যেভাবে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’র দাবী উঠিতেছে তা রাজনৈতিক দিক হইতে যুক্তিসঙ্গত ও সমর্থনযোগ্য নয়। তাহা ছাড়া, বর্তমানে এইরূপ দাবী উত্থাপন করা আমরা অপরিপক্ক ও অসময়োচিত মনে করি।”
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৬৮-৬৯ সালে যে মহান গণঅভ্যুত্থান ইতিহাসে গৌরবজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে সে সম্পর্কে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখপত্র ‘নিউ টাইমস’ পত্রিকায় এই অভ্যুত্থানের নিন্দা করা হয়। বলা হয় এটা নাকি চীনপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যকলাপ। ইতিহাস কী বিচিত্র! মাত্র দুই বছর পর যখন স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হলো তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহানুভূতি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং চীনের অবস্থান ছিল ঠিক বিপরীত। চীন পাকিস্তানের সংহতির পক্ষ নিয়ে ‍মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। আমরা যারা চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিলাম তারা তখনই চীনের এই ভূমিকার সমালোচনা করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিও তখন লাইন পাল্টে স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু চীনের ভূমিকার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে চীনপন্থীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ চরম বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করেছিল। তারা এবং ভারতের নকশানপন্থীরা এই স্বাধীনতার যুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেন।

চার.

তথাকথিত চীনপন্থী বলে পরিচিত দলগুলির মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে প্রধানত দুইটি দল। এক. কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি (নেতৃত্বে জাফর, মেনন, রনো) ও দুই. দেবেন শিকদারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ বিকালে পূর্বোক্ত কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি ঢাকায় পল্টন ময়দানে এক জনসভা করে। সেটিই ছিল পাকিস্তান আমলের শেষ জনসভা। এই জনসভায় দুই লক্ষাধিক মানুষ জমায়েত  হয়েছিল (তখন ঢাকার লোকসংখ্য দশ লক্ষের নিচে ছিল)। সেখানে বক্তব্য রাখেন কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আনোয়ার খান জুনো এবং আমি। তখনও বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের আলোচনা বৈঠক চলছে। এই জনসভায় আমরা বলি, মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ব্যর্থ হতে বাধ্য। জনগণকে গ্রাম থেকে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করার জন্য প্রকাশ্যেই আহ্বান রাখি। তখনও জানতাম না যে, সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হবেন এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ইতিহাসেরর বর্বরতম গণহত্যা সংঘটিত করবে।
২৭শে মার্চ সকালে কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন এবং আমি বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাহিত্যিক জহির রায়হানের গাড়িতে করে ঢাকা ত্যাগ করি এবং শিবপুরে আমাদের একটি শক্তিশালী কৃষক ঘাঁটিতে পৌঁছাই। গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যায় বীর মুক্তিযোদ্ধ হায়দার আনোয়ার খান জুনো। উল্লেখ্য, জহির রায়হান কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির সভ্য ছিলেন। তিনি তার গাড়িটি মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আমাদের দান করেন।
শিবপুরকে আমরা হেডকোয়ার্টার করি এবং আমাদের বিভিন্ন কৃষক এলাকায় সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দিই।


কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির অধীনে ১৪টি মুক্ত আধা মুক্ত এলাকা বা ঘাঁটি অঞ্চল গঠিত হয়েছিল। প্রায় ৩০ হাজার সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা আমাদের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের ভেতরে থেকেই। ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৬ খণ্ডে প্রকাশিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্রে এই সংখ্যাটি উল্লিখিত আছে। (মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশিত এটিই একমাত্র গ্রন্থ। যদিও আমার বিবেচনায় তাও অসম্পূর্ণ)। উপরোক্ত ১৪টি ঘাঁটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা শতাধিক।
সমন্বয় কমিটির অধীনস্থ ঘাঁটিগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘাঁটি ছিল শিবপুর, মনোহরদী, পলাশ এবং রায়পুরা ও নরসিংদীর কিয়দাংশ নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ এলাকা যেখানে মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল এক ধরনের পাল্টা গণপ্রশাসন। শিবপুরের যুদ্ধে সরাসরি সামরিক কমান্ডার ছিলেন মজনু মৃধা (প্রয়াত), হায়দার আনোয়ান খান জুনো (সদ্য প্রয়াত) ও মান্নান খান। মে মাসেই শিবপুরের অন্তর্ভুক্ত পুটিয়ার যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন ১৪ বছরের কিশোর মানিক। তার কয়েকদিন পরেই আরেকটি যুদ্ধে শহীদ হন আরেক কিশোর ফজলু।

পাঁচ.
বাগেরহাট জেলার বিষ্ণুপুরে একটি বড় মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছিল সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে। রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বে ছিলেন রফিকুল ইসলাম খোকন। যুদ্ধের একেবারে শুরুতেই মে মাসে একটি সামরিক অ্যাকশনে শহীদ হয়েছিলেন গোলাম মোস্তফা হিল্লোল (রাশেদ খান মেননের শ্যালক)।
বরিশাল শহরের নিকটবর্তী এলাকায় আব্দুর সাত্তার ও শাহ আলমের নেতৃত্বে একটি বিশাল মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছিল।
সাতক্ষীরার তালা থানায় ১৮ বছর বয়সী টগবগে তরুণ কামেল বখ্‌তের নেতৃত্বে এক বিশাল লাল বাহিনী ও মুক্তাঞ্চল গড়ে ওঠে। মনে পড়ে নভেম্বর মাসের দিকে সে এসেছিল কোলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করতে ও এলাকার রিপোর্ট প্রদান করতে। সারা রাত ধরে কথা হয়েছিল। ঠিক হয় আমিও যাব তালায়। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ভারতের দিক থেকেই বর্ডার সিল করে দেয়া হয়। আমার পক্ষে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। আরো বেদনার কথা আমি খবর পেলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা কামেল বখ্‌ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নিহত হয়েছেন।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে কাজী জাফর আহমেদের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী ঘাঁটি এলাকা গড়ে ওঠে। সামরিক কমান্ডার ছিলেন তরুণ ছাত্র নাজাদ (প্রয়াত)। রাজশাহীর নওগাঁয় আফতাব মোল্লার নেতৃত্বে মুক্তিফৌজ গঠিত হয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় তার সাথে আমার দেখাও হয়। তিনি আমাকে একটি সুন্দর স্টেনগান উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাকে তো ভারতে চলাফেরা করতে হয়। তাই সে উপহার গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ঢাকার নিকটবর্তী জয়দেবপুরেও আমাদের (সমন্বয় কমিটি) একটি ছোট ঘাঁটি ছিল। সেখানে একবার পাক বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে আমরা হটে যাই এবং আমাদের তিনজন ধরা পড়েন। তাদেরকে রাতের বেলা নদীর ধারে হাতা বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। আহসান উল্লাত শেখ গোলাপ গুলিবিদ্ধ হলেও কোনোমতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে বেঁচে যান। তিনি আজও বুকের মধ্যে তিনটি বুলেট বহন করে বেঁচে আছেন।

ছয়.
এই রচনায় আমার একটি ব্যক্তিগত কথা উল্লেখ করলে আশা করি পাঠকরা অপ্রাসঙ্গিক মনে করবেন না। ১৯৭১ সালে আমার বোন ড. আয়েশা চৌধুরী পাক দস্যুদের গুলিতে নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন আমার মা ও আমার ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আনোয়ার জুনোর স্ত্রী মাহবুবা রশীদ চপল।

সাত.
আমরা অর্থাৎ সমন্বয় কমিটি প্রধানত অস্ত্র সংগ্রহ করেছি কয়েকটিভাবে। এক. পাকিস্তানীদের আকস্মিক আক্রমণের ফলে বাঙালি সৈনিক ও পুলিশ পিছু হটে ভারতের দিকে যেতে বাধ্য হয়। আমরা তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রসমূহ সংগ্রহ করি। দুই. আমরা পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করে বিভিন্ন অস্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। শিবপুরে একবার এক পাকিস্তানী সৈন্যকে বন্দি করতেও সক্ষম হয়েছিলাম যাকে পরে মেরে ফেলা হয়। তিন. বিভিন্ন পুলিশ ও আনসার ক্যাম্প দখল করে সেখানকার অস্ত্র নিয়ে নেয়া হয়। চার. দুইজন সেক্টর কমান্ডার গোপনে আমাদের অস্ত্র দিয়েছিলেন। তারা হলেন কর্নেল নুরুজ্জামান ও মেজর খালেদ মোশাররফ।

আট.
আমরা যুদ্ধ করেছি প্রধানত দুইভাবে। দেশের ভেতরে ঘাঁটি এলাকা গঠন করে এবং মুক্তিফৌজের মধ্যে আমাদের কর্মীদের ঢুকিয়ে দিয়ে। যদিও ভারত সরকার এবং বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের কড়া নজর ছিল যাতে বামপন্থীরা মুক্তিফৌজে না আসতে পারে। তবু বেশ কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কর্নেল নুরুজ্জামান, খালেদ মোশাররফ, উইং কমান্ডার বশার, মেজর জলিল ও মেজর মনজুর আহমেদ। এখানে উল্লেখ্য যে, ’৭১ সালেই প্রবাসী সরকারের অধীনে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এক ব্যাচ কমিশনড অফিসার নিয়োগপ্রাপ্ত হন। অবশ্য এই প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। তার মধ্যেও কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সভ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশফাকুস সামাদ প্রশিক্ষণ পেয়ে লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন। উল্লেখ্য যে, সেই ব্যাচে বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামালও ছিলেন। লেফটেন্যান্ট সামাদ পুরো সময়টাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন ও আমি ভারত-বাংলাদেশ উভয় জায়গায় যোগাযোগ করতাম। ভারতের মাটিকে ব্যবহার করা ছাড়া বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যোগাযোগ করা তখনকার পরিস্থিতিতে প্রায় অসম্ভব ছিল। সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার বশারের অধীনে লেফটেন্যান্ট সামাদের ক্যাম্প ছিল বাংলাদেশের সীমানার মধ্যেই রংপুরের বুড়িমারিতে। সেখানে নভেম্বর মাসে রাশেদ খান মেননের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং দীর্ঘ আলাপ  হয়। তার কয়েকদিন পরেই লেফটেন্যান্ট সামাদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভুরুঙ্গমারীতে এক সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। সেখানে তার এবং আরো দুজন শহীদের কবর রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রতি বছর শহীদ সামাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

নয়.
১৯৭১ সালে জুনের ১ ও ২ তারিখে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, ভাসানী ন্যাপ এবং আরো কয়েকটি ছোট বাম দল ও গণসংগঠন একটি সম্মেলনে মিলিত হয় কোলকাতার বেলেঘাটায়। সেখানকার থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য ব্যবস্থাদি করেছিল ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। মনে পড়ে সিপিআইএম-এর কর্মীরা আমাদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করেছিলেন। তাদের রচিত একটি গানের লাইন আমার এখনো মনে আছে- ‘সূর্যদীপ্ত বাংলাদেশ, পরেছে আজ যুদ্ধবেশ।’ এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ভাসানী ন্যাপ নেতা বরদা চক্রবর্তী। সম্মেলনে একটি দলিল গৃহীত হয় যেখানে আমরা বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে স্বীকার করে সেই সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার প্রস্তাব রাখি। একই সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এই দলিলটি ছাপার এবং দেশে-বিদেশে প্রচারের ব্যবস্থা করেছিল ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি যা তখন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ওই বক্তব্যের একটি কপি নিয়ে কাজী জাফর আহমেদ ও আমি প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করি এবং জানাই যে আমরা মুক্তিফৌজে অংশগ্রহণ করে যুদ্ধ করতে চাই। তিনি আমাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করলেও নিশ্চিতভাবে কোনো কথা দিতে পারেননি। ভারতে আমাদের চলাফেরাও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সেক্ষেত্রেও আমাদের যথেষ্ট সহায়তা করত সিপিআইএম। তাছাড়া খালেদ মোশাররফ তার ক্যাম্পে বামপন্থীদের প্রশিক্ষণের সুযোগ দিয়েছিলেন। একবার চৌদ্দগ্রামের সামরিক কমান্ডার নাজাদ ত্রিপুরা রাজ্যে ভারতের বিএসএফ দ্বারা গ্রেফতার হন এবং তার উরুতে কয়েকটি বেয়নেট চার্জ করা হয়। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করেন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এ রকম আরো অনেক ঘটনা আছে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে সব বিবরণ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

দশ.
সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ভারত সরকার মস্কোমন্থী কমিউনিস্ট পার্টির জন্য পৃথক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। নভেম্বর মাসে তাদের একটি ব্যাচ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারা দিয়ে প্রবেশ করতে চাইলে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয় এবং নয়জন শহীদ হন। গোপালগঞ্জে সিপিবির একটি গ্রুপ বিচ্ছিন্ন অন্য একটি গ্রুপ হেমায়েতবাহিনীর সঙ্গে মিলিতভাবে যুদ্ধ করেছিল। যার নেতৃত্বে ছিলেন ওয়ালিয়ুর রহমান লেবু ও কমলেশ বেদজ্ঞ। এটা খুবই বেদনাদায়ক যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই এই দুই নেতাই আততায়ীর হাতে নিহত হন। শোনা যায়, হেমায়েত বাহিনীর লোকরাই তাদের হত্যা করেছিল।

এগার.
বামপন্থীদের অন্যান্য যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেবেন শিকদারের নেতৃত্বাধীন পার্টিটি। তাদের পার্টির নেতা ওবায়েদ বলির নেতৃত্বে চট্টগ্রামের মীররসরাই থানায় একটা শক্তিশালী বাহিনী গড়ে উঠেছিল।
মাওবাদী বলে দাবিদার সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে পিরোজপুরের পেয়ারা বাগানে একটি আধামুক্ত এলাকা গঠিত হয়েছিল। সিরাজ শিকদার অবশ্য বাংলাদেশ সরকারকে মেনে নেননি। সুখেন্দু দস্তীদার-ত্বোহা-হকের নেতৃত্বে EPCP(ML) এবং উত্তরবঙ্গে আবদুল মতিনের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির একাংশ চীনের লাইনের কারণে বিভ্রান্তিকর অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে গুরুত্ব না দিয়ে তথাকথিত কৃষিবিপ্লবের লাইন গ্রহণ করেন। তারা একই সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই এক কাতারের শত্রু হিসেবে দাঁড় করান। তবু পাক বাহিনীর  হাত থেকে তারা রক্ষা পাননি। আবদুল মতিনের বাবা এবং ভাই পাক বাহিনীর হাতে নিহত হন। তাদেরই দলের ওহিদুর রহমান আত্রাই অঞ্চলে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেছেন (পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন)। অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় নোয়াখালীর চর জঙ্গলিয়ায় ইপিসিপিএমএলের নেতা মোহাম্মদ ত্বোহা স্বীয় পার্টি লাইনের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ সংগঠিত করেন এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগারদের সঙ্গে কৌশলগত সন্ধিও করেন। ওই চরাঞ্চলে তিনি কৃষকের মধ্যে জমিও বিতরণ করেছিলেন।

বার.
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে এককভাবে আওয়ামী লীগের হাতে ছিল- একথা আমি আগেই বলেছি। প্রবাসী সরকার আওয়ামী লীগের নেতাদের দিয়েই গঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সরকারের পাশাপাশি একটা উপদেষ্টা কমিটিও ছিল। সেই উপদেষ্টা কমিটির প্রধান ছিলেন মাওলানা ভাসানী। আরো ছিলেন মণি সিংহ, মোজাফফর আহমেদ ও কংগ্রেস নেতা মনোরঞ্জন ধর। একমাত্র মনোরঞ্জন ধর বাদে বাকি তিনজনই বামপন্থী নেতা। এতেই বোঝা যায় বামপন্থীদের অবস্থান অগ্রাহ্য করা ইতিহাসসম্মত নয়।

তের.
এই মহান মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন দল ও মানুষ বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। বামপন্থীদের কথা তো একটু আগেই উল্লেখ করা হলো। এছাড়া ছিল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরীয়া বাহিনী যা বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল এবং সরাসরি ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। ভারতীয় সেনাবাহিনী আরেকটি গ্রুপকেও বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল যার নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের তরুণ নেতারা। এটাও প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এই বাহিনীর নাম ছিল বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স যা মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। এই বাহিনী বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত এবং অধিকতর উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত। এই বাহিনী বিশেষ কোনো যুদ্ধ করেনি। যুদ্ধের শেষ দিকে তাদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়েছিল। তাদের টার্গেট ছিল বামপন্থী ঘাঁটিগুলোকে ধ্বংস করা। কিন্তু সে কাজে তারা বিশেষ সফল হননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও মুক্তিফৌজের সাধারণ সদস্য যাদের বলা হতো ফ্রিডম ফাইটার, তাদের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর ছোট-বড় সংঘর্ষ বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত চলেছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। যত বিলম্ব হবে ততই উপাত্তসমূহ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়বে। শুধু এইটুকু বলে আমি উপসংহার টানতে চাই যে, এই যুদ্ধ ছিল প্রধানত জনতার যুদ্ধ। বামপন্থীদের অংশগ্রহণ ছিল গৌরবজনক যদিও সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল আওয়ামী লীগের হাতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকলেও তার স্পিরিট যেন সমগ্র জনগণকে যুদ্ধের জন্য প্রেরণা যোগাত এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধকে একরৈখিকভাবে দেখা ভুল হবে। তার বৈচিত্রময় দিককে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারলেই ইতিহাসকে যথাযথভাবে তুলে ধরা সম্ভব।

লেখক পরিচিতি
জন্ম- ১৯৪২, কলকাতা। মুক্তিযোদ্ধা, বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা। ১৯৬১ সালে তৎকালীন বেআইনী কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হয়েছিলেন। ১৯৬৩ থেকে ’৬৫ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬৮-’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক, ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের সৈনিক। চারবার কারবরণ করেছেন, হুলিয়া নিয়ে আত্মগোপনে গেছেন সাতবার, পুলিশ-মিলিটারি কর্তৃক তার বাসায় রেইড হয়েছে ৫০ বারের বেশি। মার্কসবাদ, রাজনীতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, দর্শন, সাহিত্য ও বিজ্ঞান (পদার্থবিদ্যা)-এর উপর সর্বমোট ২৫টি বই লিখেছেন, প্রবন্ধের সংখ্যা অসংখ্য। এক সময় নিয়মিত খবরের কাগজে লিখতেন।

সৌজন্য: মার্কসবাদী পথ

https://www.marxbadipath.org/article/Role-of-Leftists-in-Freedom-Fight-of-Bangladesh/75

Comments :0

Login to leave a comment