স্বাস্থ্য সিন্ডিকেটের
তিন মাথাকে
রাত পর্যন্ত জেরা
নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা, ২১ সেপ্টেম্বর- বিরুপাক্ষ বিশ্বাস-অভীক দে-সৌরভ পাল। আর জি করের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সামনে আসা তিনটি সব থেকে রহস্যজনক চরিত্র। তদন্তের গতি বাড়িয়েই শনিবার সিজিও কমপ্লেক্সে তিনজনকে এক টেবিলে বসিয়ে জেরা করল সিবিআই।
রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলো স্বাস্থ্য সিন্ডিকেটের চেনা মুখ তিনজনেই। এর মধ্যে মাথা অভীক দে। স্বাস্থ্যভবনও যার দাপটে তটস্থ থাকতো। খাতায় কলমে অধ্যক্ষ বা সুপার হলেও অভীক দে’র কথাতেই চলত আর জি কর থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের যাবতীয় কারবার। মূলত দুর্নীতির চক্র। মহিলা পড়ুয়া চিকিৎসকদের দিনের পর দিন নানান ভাবে হেনস্থা, শারীরিক অত্যাচার এমনকি হাসপাতালের ভিতরে মধুচক্র বসানোর কারবারেরও মাথা এই অভীক দে।
তলব পেয়ে শনিবার সকালে সিজিও কমপ্লেক্সে প্রথমে হাজির হন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের প্যাথোলজি বিভাগের সিনিয়র রেসিডেন্ট বিরূপাক্ষ বিশ্বাস। প্রথম দফায় বেশ কিছুক্ষণ তাকে জেরার পরে বয়ানের সূত্রে ধরেই এরপরে তলব করা হয় থ্রেট সিন্ডিকেটের অন্যতম মাথা বর্ধমানের প্রাক্তন আরএমও, এসএসকেএম হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের পিজিটি অভীক দে’কে। দুপুরে সিজিও কমপ্লেক্সে আসে স্বাস্থ্য সিন্ডিকেটে শাসক তৃণমূলের অন্যতম মুখ এই চিকিৎসক। এরপরে চলে তাকে দফায় দফায় জেরা। দু’জনকে মুখোমুখি বসানো হয়। সন্দীপ ঘোষের বয়ান ধরেও চলে জেরা। এরপরে ফের তলব করা হয় আর জি করের রেডিওথেরাপি বিভাগের সিনিয়র রেসিডেন্ট, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য কমিটির সদস্য সৌরভ পালকে। তলবের পরে বিকালে দিকে সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরা দেয় সৌরভ পাল। আর জি করে দুর্নীতির চক্র, টাকা বিনিময়ে পিএইচডি’র অনুমতি মেলার যে চক্র, তার অন্যতম এজেন্ট এই সৌরভ পাল। চলে তিনজনেরই দফায় দফায় জেরা।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রের দাবি, ঘটনার মূল সত্যে পৌঁছানোর একেবারে কাছাকাছি আসতে সাহায্য করবে এই জেরা পর্ব। তদন্তের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে চলেছে এই তিনজনের জেরা। রাত পর্যন্ত দফায় দফায় চলছে জেরা। দশ ঘণ্টা পেরোতে চলেছে। গ্রেপ্তারির সম্ভবনাও বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রের দাবি অভীক দে, বিরুপাক্ষ বিশ্বাস ও সৌরভ পাল - এই তিনজনই সেদিন অর্থাৎ ৯ তারিখ চারতলায় চেস্ট মেডিসিনের সেমিনার রুমে হাজির ছিল। কেন? বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ থেকে শাসক তৃণমূলের সক্রিয় চিকিৎসক নেতা বিরূপাক্ষ বিশ্বাস কেন ছুটে এসেছিলেন আর জি করের চার তলায়? কার ফোনে? বর্ধমান থেকে অত তাড়াতাড়ি কীভাবে পৌঁছে গেলেন আর জি করে? খবর কী তারা সকালের আগেই পেয়েছিলেন? রাতেই পেয়েছিলেন? কার মাধ্যমে? যদি রাতে না জানতে পারেন তাহলে সকালের মধ্যে কীভাবে চলে আসলেন? নাকি ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত, তাই কলকাতার আশেপাশেই ছিলেন? কার ফোনে খবর পেয়েছিলেন? মনে করা হচ্ছিল সন্দীপ ঘোষের মাধ্যমেই জানতে পেরেছিলেন তিনি। তদন্তের গতিতে ক্রমেই সন্দীপ ঘোষকে পিছন ফেলে সামনে আসে অভীক দে’র ছায়া। অভীক দে’র ফোন থেকেই কেন ডাকা হয়েছিল থ্রেট সিন্ডিকেটের বাহিনীকে? একের পর এক প্রশ্নে রীতিমত বেকায়দায় শাসক তৃণমূলের হুমকির সংস্কৃতির অন্যতম এই পান্ডা। আর জি কর কাণ্ডের আবহে একটি অডিও ভাইরাল হয়েছিল। ভাইরাল হওয়া সেই অডিওর সূত্র ধরেই উঠে আসে বিরূপাক্ষের নাম। বিরূপাক্ষকে সেই অডিওতে জুনিয়র ডাক্তারদের হুমকি দিতে শোনা গিয়েছিল। এরপরই তার বিরুদ্ধে বৌবাজার থানায় লিখিত অভিযোগও দায়ের করা হয়। জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়ায় বিরূপাক্ষকে ইতিমধ্যে সাসপেন্ড করেছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রের দাবি, তদন্তের স্বাভাবিক গতিতে প্রতিটি বাঁকের মুখে আসছে অভীক দে’র নাম। তিনি এতটাই ‘প্রভাবশালী’ যে চার তলার সেমিনার রুমের ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও-তে তার ছবি দেখা গেলেও, তাকে আড়াল করতে ময়দানে নামে খোদ কলকাতা পুলিশ। গত ৯ আগস্ট সকালের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। তাতে দেখা যায় ক্রাইম সিনে অর্থাৎ চারতলার সেমিনার রুমে যখন ওই চিকিৎসক পড়ুয়ার দেহ পড়ে রয়েছে সেই সময়তেই একাধিক মানুষের ভিড়, কার্যত মেলার মতো। স্বাভাবিক ভাবেই ওই ভিডিও-তেই স্পষ্ট হয় পরিকল্পিত ভাবে এত মানুষকে সেখানে ঢুকতে দিয়ে ক্রাইম সিন নষ্ট করা হয়েছে। ক্রাইম সিনের একটি ছবি প্রকাশ্যে আসে, তাতে লাল জামা পরা এক ব্যক্তিকে দেখা যায়। কলকাতা পুলিশ তাঁকে ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞ বলে চালিয়ে দিয়েছিল। পরে জানা যায়, লালা জামা পরা ব্যক্তির নাম অভীক দে। তিনি এসএসকেএম হাসপাতালের পিজিটি, ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞ নন। এমনকি খোদ আইএমএ প্রশ্ন তুলে বলেছিল, এই অভীক দে আবার ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞ হলেন কবে!
শুধু তাই নয়, তাঁর পিজি কোর্সে ভর্তি নিয়েও বেশ কিছু বিতর্ক হয়েছিল। যদিও বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের আরএমও থাকাকালীন ওই কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ কৌস্তভ নায়েক তাঁকে অন্য হাসপাতালে কাজ করার মিথ্যা সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, যাতে সার্ভিস কোটায় তিনি পিজি কোর্সে ভর্তি হতে পারেন। এছাড়াও নানা সরকারি কাগজপত্রের হেরফের ঘটানো হয়েছে তাঁর ক্ষেত্রে, যার প্রতিদানে প্রথম ইন্টারভিউয়ের ফলাফল বের হওয়ার আগেই দ্বিতীয় ইন্টারভিউতে ডাঃ কৌস্তভ নায়েক বহু সিনিয়র ও যোগ্য অধ্যক্ষকে টপকে ডিরেক্টর অব মেডিক্যাল এডুকেশন পদে আসীন হয়েছিলেন।
এহেন শাসক দলের দাপুটে নেতা সকালে কেন চলে এসেছিলেন আর জি করের চারতলার সেমিনার রুম? কী আড়াল করতে, কী লোপাট করতে? কার নির্দেশে? এসএসকেএম থেকে ছুটে আসতে হলো কেন তাকে? দফায় দফায় জেরার মুখে অভীক দে। মুখোমুখি বিরূপাক্ষ বিশ্বাস ও অভীক দে’কে জেরার করার পরেই তলব করা হয় আর জি করে তৃণমূলের আরেক উঠতি নেতা, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য কমিটির সদস্য সৌরভ পালকে। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছিলেন সৌরভ পাল। আর জি করে আশিস পান্ডেদের চক্রে খুব দ্রুত সামনে চলে আসে সে। সেও ছিল সেদিন ঘটনাস্থলে চারতলার সেমিনার রুমে। ৮ তারিখের রাতের ঘটনাও কী সে জানত? চলছে দফায় দফায় জেরা। সন্দীপ ঘোষের বয়ান ধরে জেরাতেই একের পর এক বিভ্রান্তিকর জবাব মিলছে। ফলে বাড়ছে গ্রেপ্তারির সম্ভাবনাও।
Comments :0